Monday, December 17, 2018

ইয়োরোপ


দা ডাই হার্ড সাক্ষাৎকার
পৃথিবীর নানান লেখক, কবি, প্রকাশকদের সঙ্গে কথাবার্তা


শনিবার, ১লা জানুয়ারি, ২০১১

শুভঙ্কর দাশ, একটা স্বাধীন পথ

শুভঙ্কর দাশ হলেন একজন লেখক, প্রকাশক, ফিল্ম প্রজোজক। থাকেন কোলকাতায়, ভারতে। তার প্রকাশিত বাংলা কবিতার বইয়ের সংখ্যা ১৪ যদিও তার সদ্য প্রকাশিত বই The Streets, the Bubbles of Grass ইংরেজিতে তার আর্টস কালেক্টিভ গ্রাফিত্তি কোলকাতা থেকে প্রকাশিতউনি অ্যালেন গিন্সবার্গের ক্যাডিস বাংলাতে অনুবাদ করেছেন আর সম্পাদনা করেছেন The stark electric space-এর। এটি একটি আন্তর্তজাতিক পরিক্ষা মূলক লেখালিখির সংকলন। উনি ৬ টা  ছোট ছবি প্রযোজনা করেছেন আর একটা বইয়ের দোকান আছে তার।



ডাই হার্ড – আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে কিছু বলুন। আপনি কবে কবিতা লিখতে শুরু করলেন?

শুভঙ্কর – বাংলায় একটা প্রচলিত বাক্য আছে –‘একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল’ – যেটা আমি ফের লিখেছিলাম এভাবে, বা আমি বলতে চাইব ওটাকে রিমিক্স করেছিলাম এভাবে – ‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল’ – আর আমি জানিনা কবে কবিতার হাড়ে আঁটকে গেছিলাম। শুধু মনে আছে ৯ বছর বয়সে একটা কবিতা লিখে পুরষ্কার পেয়েছিলাম আমি, বাংলা ভাষার সাথে হিন্দি শব্দ মিশিয়ে একটা ছন্দে লেখা কবিতাতে।
আমি জন্মেছিলাম ১৯৬৩ সালে কোলকাতায়দু ভাই আর এক বোনের ভেতরে আমি ছিলাম সবার ছোট। আমার বাবা ছিলেন এক জমিদার সন্তান যাদের প্রচুর জমি জায়গা ছিল মেদিনীপুরে, কোলকাতা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে একটা গ্রামে ছিল তাদের বসত বাড়ি। জমিদারদের সাধারণত থাকত প্রচুর জায়গা জমি আর বন্ডেড লেবারদের প্রতি তাদের নিষ্ঠুর ব্যবহারের বদনাম।
আমার বাবা বাড়ি ছাড়েন লাভ ম্যারেজের জন্য প্রভূত বাওয়ালের জন্য আর কোলকাতায় চলে আসেন একজন ছোট ব্যবসাদার হিশেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তার সঙ্গে ছিল তার বউ আর এক বছরের সন্তান, আমার দাদা। সাহিত্য নিয়ে আমার বাবা-মায়ের কোনো ধ্যান ধারণা ছিল না, কবিতা তো অনেক দূরের ব্যাপার। কিন্তু তাদের মিথ, রূপকথা, রূপক কাহিনী আর উপকথার প্রতি ভালোবাসা ছিল যা আমার কাছে ছিল আশির্বাদ স্বরূপ। আমার ঠাকুমা মুখস্ত বলতে পারতেন ছন্দে বোনা রামায়ণ আর মহাভারত, যা প্রতিটাই প্রায় হাজার পাতার বেশি। ছোটো বেলার সেই সময়টুকু এখনো আমার জন্য সব থেকে বেশি সুররিয়াল হয়ে থেকে গেছে।
আমার বাবা-মা চাইতেন আমি ইঞ্জিনিয়ার হই আর ভুলে যাই আমার জমিদারি রক্তের কথা। তো আমি ইঞ্জিনিয়ার হলাম তারপর একদিন বিরক্ত হয়ে, যদিও বিরক্ত শব্দটা ততটা ঘৃণা জাগানো শব্দ নয় যা আমি টের পাচ্ছিলাম এই করপোরেট দুনিয়ার প্রতি, ওই পাউডার মাখা জন্তুগুলো যারা কিছুরই কিছু জানেনা, ঠাণ্ডি ঘরে বসে যারা বিগ বস-এর অভিনয় করে চলে। আমাকে চিন্তা করতে বারণ করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল অর্ডার মোতাবেক কাজকর্ম করতে। তো মাস ছয়েক পরে আমি ওই চাকরি ছেড়ে মন দিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করি। মাঝে মাঝে ছোটখাটো উলটো পালটা কাজ করেছি, ইন্সিয়োরেন্সের দালালি থেকে কম্প্রেশারের স্পেয়্যার পার্টস বিক্রি, বা আমার বাবার দোকানে দোকানদারের কাজ, জাঙ্গিয়া আর বাচ্চাদের জামাকাপড় বিক্রি করা। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর ওটাকে আমি বইয়ের দোকান বানাই যে দোকান আমার এখনো আছে।

আপনি কবে থেকে কবিতা প্রকাশ করতে শুরু করেন?

প্রথম ছন্দবদ্ধ কবিতাটা যেটার জন্য আমি পুরষ্কার পাই ছাপা হয়েছিল একটি কমার্শিয়াল কাগজে অন্যান্য কবিতার সাথে। সেটা ছিল একটা বিশেষ সংখ্যা যেমন এ ধরণের কাগজগুলো করে থাকে। শয়ে শয়ে ঝাঁ চকচকে রঙিন পাতা যা প্রকাশিত হয় কোনো এক উৎসবের সময়ে যাতে তাদের বিক্রি বেশি হয়। মাঝে মাঝে এসব কাগজের সাথে আপনি ফ্রি পেতে পারেন ওয়াশিং পাউডারের স্যাসেও
তো আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল এমন এক পাবলিশিং গ্রুপের কমার্শিয়াল পত্রিকায় যাদের আমি পরে ঘৃণা করতে শিখেছি। যখন দেখেছি তারা কীভবে সৃষ্টিশীল লেখকদের দলদাস বানায়, কীভাবে একজন ভাল ছোট গল্পকারকে স্পোর্টস জার্নালিস্ট বানায় তারা বা একজন কবিকে চুটকি কলাম লেখক। বাংলা ভাষায় আমি তাই লিটল ম্যাগাজিনের লেখক থাকতে চেয়েছি যা বিশ্বাস করবে স্বাধীন পথে, যা লেখকের স্বাধীনতা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেবে। ট্র্যাকের বাইরে, অন্যধরণের লেখা পত্র ছাপা হয় এই ভিন্ন রাস্তায় চলা লিটল ম্যাগাজিনগুলোতেআমি যেখানে লিখে আরাম পাই।


সাম্প্রতিক উত্তরণের সম্পাদক ভাবছি্লেন আবার নতুন ভাবে তার লিটল ম্যাগাজিনটা বার করবেন। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন সম্পাদক হিসেবে তার কাগজের সঙ্গে জড়িত হতে। ওই কাগজের সঙ্গে বহু বছর আমি কাজ করেছি। প্রচুর অনুবাদের কাজ করতে দিয়েছিলেন উনি। ওই সময়ে আমার প্রথম কবিতার চ্যাপ বই ‘বিকৃত মস্তিষ্কদের গান’ বেরিয়েছিল ওই লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশনা থেকে।

আপনার প্রিয় কবিরা কারা? ওদের কাছে থেকে আপনি কী শিখেছেন?

ওঁরা হলেন জীবনানন্দ দাশ, ৩০-এর দশকের একজন বাঙালি কবি, আর অ্যালেন গিন্সবার্গ, আমেরিকার বিট কবি। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি, যার কবিতা এখনো শরীরের ভেতর কাজ করে, সাইকোসোম্যাটিক্যালি, গায়েগতরে, বুদ্ধি আর আর চালাকি সরিয়ে রেখে। ‘শুধু মাথার গুরুত্ব দিও না – বুদ্ধি আর চালাকির উপর নির্ভর কোরো না শুধু’। - সুভাষ ঘোষ, ৬০ দশকের একজন হাংরি গদ্যকার একথা আমাদের বার বার বলতেন। ‘যখন শরীর সাইকোসোম্যাটিক্যালি রিয়্যাক্ট করে, তোমার ভাব প্রকাশের অস্ত্র, কাজ করে ঠিকঠাক’। আমি এটা অনুভব করেছি জীবনানন্দের কাজে। আমি শব্দের বিপন্নতা শিখেছি তাঁর কাছে। চাঁদের অন্ধকার দিক। কতটা জরুরি একটা কমা বা দাড়ির।
গিন্সবার্গ আমাকে শিখিয়েছেন বাস্তব জীবনের কথ্য শব্দের ব্যবহারিক রূপ, কীভাবে লোকাল গ্লোবাল হয়ে ওঠে। ওই অপ্রয়োজনীয় অলঙ্কার কীভাবে খুলে দিতে হয় যাতে ভাষা স্মৃতিতে জাগিয়ে তোলে গদ্যের রূপ। আমার এখনো মনে আছে তাঁর ওই কথা যা কিছুটা এরকম, -‘আমার কবিতায় বাক্য কতটা লম্বা হবে তা নির্ভর করে পাতাটা কতটা বড় তার উপর’। এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁর ভারত ভ্রমণের পর গিসবার্গের কবিতার লাইন নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ভারতীয় মন্ত্র আর প্রাণায়ামের নিঃশ্বাস নেওয়া আর ছাড়ার পদ্ধতির উপর। পরের দিকে তাঁর ভালো আর খারাপ অনুরননের উপর বিশ্বাসও এই প্রাচ্যের মন্ত্রের প্রভাবে ঘটেছিল। উত্তর আধুনিকতায় লোকালকে গ্লোবাল ভাবার এই চিন্তা আমাকে তাঁর লেখালিখির উপর অনেক বেশি আকর্ষিত করে। আমি গিন্সবার্গের ক্যাডিস বাংলায় অনুবাদও করেছি।

কিছুদিন আগেই যে সংকলন আপনি বের করেছেন, the stark electric space… সেখানে হাংরিদের দিকে আরেকবার ফিরে দেখার প্রচেষ্টা আছে বা ৬০ দশকের হাংরি মুভমেন্ট যা ভারতে ঘটেছিল। ওই মুভমেন্ট কতটা আপনার কাজকর্ম বা দেখার ভঙ্গীকে প্রভাবিত করেছে? 

হাংরি মুভমেন্ট বাংলা সাহিত্যের মনোভাব বা ধারণার একটা বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। যদিও আমি মনে করি যে কোনো ধরণের মুভমেন্ট একটা রেজিমেন্টেশন শেষ অবধি তৈরি করে। নানান গ্রুপ তৈরি হয় আর লেখকের স্বাধীনতার বলি চড়ানো হয় মুভমেন্টকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে। কিছুদিন আগেই মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে (হাংরি মুভমেন্ট যাঁর হাতে শুরু) কথাবার্তায় আমি এই প্রশ্ন তাঁর কাছে রেখেছিলাম তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন পশ্চিমী মুভমেন্টের সাথে হাংরি মুভমেন্টকে গোলালে চলবে না। হাংরি মুভমেন্টের কোনো কেন্দ্রীয় পাওয়ার সেন্টার ছিল না, হাই কমান্ড বা পলিটবুরো ছিল না। যে কেউ বা সবাই ছিলেন স্বাধীন এই মুভমেন্টে যোগ দেওয়ার জন্য, শুধু তিনি হাংরি এই কথাটি ঘোষণা করতে হতো। ঘটনা হচ্ছে পরের দিকের অনেক হাংরিকে আমি আজও চিনি না’।


কিন্তু তবু আমার মনে হয় হাংরিদের এই ক্লোজড গ্রুপের জন্য, পরের দিকের হাংরিদের স্বীকার করা হয়নি, আর হাইকমান্ড বা লিডার গড়ে ওঠার জন্যই হয়ত এই মুভমেন্ট শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এর জন্য তাদের ডিফায়েন্সকে অস্বীকার করার মানে হয় না, বা তাদের ফর্ম নিয়ে পরিক্ষা নিরিক্ষার পরও মূল কন্টেন্ট অটুট রাখার কথা আমরা জানি আর তাদের টেক্টে subjective personal feelings, এগুলো আমাকে নাড়িয়েছিল আর তাই তাদের ছাড়া একটা ইন্ডি সংকলন হতেই পারে না বলে আমার মনে হয়েছিল।

একটা কবিতা কীভাবে আপনি তৈরি করেন? কোথা থেকে তার প্রেরণা পান?

এটা সাধারণত এভাবে ঘটে, একটা শব্দ, কখনো একটা গোটা বাক্য, আমার মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে কয়েক দিন ধরে যতক্ষণ না আমি সেটাকে লিখে ফেলছি। তারপর আরো শব্দ তার সঙ্গে জুড়ে যায়। এটা সাধারণত ঘটে ছোটো কবিতার ক্ষেত্রে। কিন্তু বড় কবিতার ক্ষেত্রে খানিকটা রিসার্চ থাকেই। কখনো কখনো একটা ঐতিহাসিক পটভূমি তৈরি করে একটা বাক্য বা একটা শব্দ।


ধরা যাক আমার বড় কবিতা ‘অজয়ের পাড় ধরে জয়দেব কোথায় যে হেঁটে চলে গেল’-র ক্ষেত্রে আমাকে তিনটে বইয়ের নাম করতেই হবে যা এই কবিতার পেছনে প্রেরণা জুগিয়েছে। ‘Who was Sinclair Beiles’ যা সম্পাদনা করেছিলেন গ্যারি কামিস্কি আর এভা কোয়ালস্কা, ‘The Colossus of Marousi’ যা লিখেছিলেন হেনরি মিলার আর হেনরি দিনান্দারের বই ‘Mr Blue’ এবং ‘হাইড্রা’ শব্দের নানান রকম রূপ আমাকে তাড়া করে ফিরছিল বহু দিন ধরে। হাইড্রা, গ্রিসের একটা দ্বীপ, একটা সময় ছিল বোহেমিয়ানদের স্বর্গ রাজ্য যা গ্রিক রূপকথার সেই জলের জন্তুটাও যার ছিল নটা মাথা। আমি বাংলার সেই মিথ হয়ে যাওয়া কবির কথাও ভাবছিলাম, জয়দেব, যার বাড়ি ছিল অজয়ের পাড়ে। যেখানে আজও তার স্মৃতিতে একটি গ্রামীণ মেলা বসে। বাউল সাধকরা সারা রাত গান গায় রাধা কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস রাধা কৃষ্ণের প্রেমের মিথকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। এছাড়াও আমি ভাবছিলাম আজ যারা তাদের ছেলের নাম জয়দেব রাখে তারা কি জানে জয়দেব আসলে কে ছিলেন? এই পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে খুব ম্যাজিকাল আর কাব্যিক মনে হয় আর এটা আমাকে লিখতে প্রেরণা যোগায়।
আমি মনে করি প্রথম চিন্তাই সেরা চিন্তা তাই খুব একটা কাটাকুটিতে আমি বিশ্বাস করি না, যদিও আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ শুধু যে বার বার কাটাকুটিতে বিশ্বাসই শুধু করতেন তাই নয়, তিনি প্রুফে আবার নতুন করে লিখতেন, আর মাথা খারাপ করে দিতেন প্রিন্টারের।
আমার কাছে কবিতা শুধু শব্দ সাজানো নয় বরং উলটোটা, তাতে লেগে থাকবে ঘাম, লোম,  থুতু, কফ, পিত্ত – এই সবকিছু থাকে একটা কবিতার ভেতর। আমার রাগ, দুঃখ, যন্ত্রণা, হতাশা, ভাবপ্রবণতা, প্রেম – এই সমস্তই আছে ওই কবিতার হাড়ে। আমি শুধু ওই হাড়গুলোকে সাজাই যখন ইচ্ছে করে। একই কথা খাটে কবিতা ছাপার ব্যাপারেও।



আপনার আর্টস কালেক্টিভ গ্রাফিত্তি কোলকাতা নিয়ে কিছু বলুন।

বাংলায় আমাদের প্রকাশন সংস্থার নাম গ্রাফিত্তি আর আমরা প্রচুর বই বার করেছি – একশোর বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে আর একশোর বেশি ইস্যু আমাদের পত্রিকার প্রকাশিত হয়েছে বাংলায়, সেখানে আছে আমার কবিতার বইগুলো আর অনুবাদের কাজগুলো। আর তিরিশজনের বেশি অন্য ধরণের লেখকদের কাজও আছে গত ১৮ বছরের এই পথ চলায়।
২০০৪ সাল নাগাদ আমরা অডিয়ো ভিসুয়াল নিয়ে কাজ করতে শুরু করি, তৈরি হয় ৬ টা ছোটো ফিল্ম। এ সময়টাতে আমরা বাংলা লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করি, প্রাথমিক ভাবে যা ছিল ছোটো ফিল্মগুলোকে সাবটাটেল দেওয়ার জন্য যাতে যারা বাংলা জানেন না তাদের কাছেও এই কাজ পৌঁছনো যায়। ভারতেও বাংলা একটা প্রাদেশিক ভাষা মাত্র। আমার প্রচুর বন্ধু বান্ধব আছেন যারা বাংলা পড়তে বা বলতে জানেন না। এই প্রচেষ্টা ছিল সেই ফাঁকটাকে কমিয়ে আনার জন্য। আমরা একটা ব্লগ শুরু করি ইংরেজিতে যারা নাম ‘গ্রাফিত্তি কোলকাতা’। ২০০৮ সাল নাগাদ। এটা বেরোয় ইংরেজিতে যেখানে বেরোয় সারা পৃথিবীর লেখকদের কবিতা আর আমাদের প্রথম ইংরেজি সংকলন যা ছাপা হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ২০১০ এ সেটা হলো the stark electric space তারপর নানান কবিতার চ্যাপ বই।। এসব কাজে আমাকে টাকা জুগিয়েছে আমার বাঁ ডান ব্যাক পকেটেরা। যদিও শুনেছি কবিতার জন্য নাকি ফান্ড পাওয়া যায় কিন্তু তার পিছনে ডান বাম পলিটিকাল দলগুলো উৎসাহ দেয় যা আমাদের না পসন্দ। আমরা স্বাধীন থাকতেই বেশি পছন্দ করি। স্বপ্ন আর জীবনের যন্রণা আমাদের ইন্ধন যোগায় এইসব কাজকর্মে। আমাদের কাছে গ্রাফিত্তি একটা আন্দোলন...গ্রাফিত্তি একটা যাপন... এটা আমাদের স্বপ্নের একটা পথ...চিন্তার কঞ্জিউমারিজমের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ... আর এখন সারা পৃথিবী জুড়েই আমাদের বন্ধু বান্ধব আছেন যারা বিশ্বাস করে্ন এই স্বাধীনতায়, এই সৃষ্টিতে।

কোলকাতায় কবিতার হালচাল কেমন?

১৯৮০ বা তারপর যারা বাংলায় কবিতা লিখেছেন বা লিখছেন তাদের সৃজনশীল অস্থিরতার সঙ্গে নিজেদের চিহ্নিত করতে হয়েছে তাদের চারপাশে যা ঘটছে তার সঙ্গে, খুন, টেরোরিজিম, মাওবাদ, দুর্নীতি ইত্যাদির সঙ্গে। তার ফলে তাদের লেখালিখি কমার্শিয়াল লেখালিখির থেকে আলাদা হয়েছে ভাষায়, ভাব প্রকাশে।


বাংলাদেশকে মাথায় রাখলে বাংলা বইয়ের বাজারটা বেশ বড়। প্লেনে করে গেলে যা মাত্র আধ ঘন্টা দূরে। একটা গোটা দেশ যার ভাষা বাংলা।
তো এই বাজার ধরতে প্রচুর টাকা ঢালা হয়ে থাকে। আর এই অবস্থায় স্বাধীন লেখকেরা যে লড়াইটা লড়ে তা শব্দের। বড় কমার্শিয়াল কাগজে তাদের রিভিউ জোটে না। তাদের নামও অনেক পাঠক শোনেননি তাই।
লড়াইটা কঠিন কিন্তু তা বলে লড়াই ছেড়ে কেউ কেউ পালালেও অনেকেই আছেন যারা লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন।
 যে কমেন্টগুলো পাঠকেরা করেছেন এই সাক্ষাৎকার পড়ে 

হ্যাঙ্ক ডি
শুভঙ্কর একজন দারুণ কবি আর খুব ভালো একটা মানুষ আর এটা সত্যিই আগ্রহ নিয়ে পড়বার মতো। ধন্যবাদ।
জানুয়ারি ২, ২০১১

ফেডেরিকা নাইটেঙ্গেল
এই সাক্ষাৎকারটা পড়ে এত ভাল লাগল, শুভ একজন ভাল কবি আর অনুবাদকও। ওর কাজ আমার সত্যিই ভালো লাগে। শুভেচ্ছা।
জানুয়ারি ২, ২০১১

জুন নন্দী
শুভঙ্করকে ব্যক্তিগত ভাবে জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছে আর একজন ভাল কবি ছাড়াও ও একজন খুব সুন্দর মানুষ। এই সাক্ষাৎকারটি তরুণ কবিদের জন্য নির্ণায়ক এবং উদ্দীপক হিশেবে কাজ করবে আর তরুণরা বুঝতে পারবে কীভাবে স্বাধীন চিন্তা নিয়ে কাজ করে টিকে থাকা যায়।
আমার শুভেচ্ছা ওর ভবিষ্যতের কাজকর্মের জন্য।
জানুয়ারি ৮, ২০১১ 
   

           

Monday, September 17, 2018

কোলকাতা – মুম্বাই – ইস্তানবুল – স্টকহোম/ দ্বিতীয় পর্ব











তো হাইড্রার একটা তুমুল বোহেমিয়ান ইতিহাস আছে। আর্টিস্ট, লেখক, গায়কদের আড্ডাখানা ১৯৬০-এর সে সময়টা ছিল বিল-এর বারে। দেওয়ালে কারপেট, মাটিতে কুশন, দেওয়ালে পিন দিয়ে আঁটকানো কবিতা। একে বোলা হোত – ‘The most important watering hole in the Mediterraninean for the alcoholic jet set’.  এখানে মাঝে মাঝে জ্যাকি ওনাসিস আর মিক জ্যাগারকেও দেখা গেছে।
হেনরির এই বইটার ব্যাক ড্রপো ছিল হাইড্রা। সেখানে একজন কবি যার নাম মিস্টার ব্লু। সেই থেকে আমি হেনরিকে মিস্টার ব্লু বলে ডাকি।
অতএব মিস্টার ব্লুর সাথে প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর, কোলাকুলির পর আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলাম। একটা ঝাঁ চকচকে ট্যাক্সি। লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ। চালকের ডান দিক চেপে একটা ছোট জিপি আর এস স্ক্রিন। যাতে সমানে রাস্তার দিকনির্দেশ ফুটে উঠছে 
হেনরির পাতলা চুল, দাঁড়ি। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে চলাফেরা করে। আমার থেকে বছর দশেকের বড়। কিন্তু তার সারা শরীর থেকে একটা বন্ধুত্বের উষ্ণতা যা আমাকে এই শূন্য তাপাঙ্কেও আরাম দিচ্ছিল। আমরা কথা বলছিলাম বুকাওস্কি নিয়ে। আমাদের দুজনেরই প্রিয় এই অ্যামেরিকান কবি। হেনরির বই উইক্স লাইক দিস-এর ব্যাক কভারে জেফরি এইচ উইনবার্গ-এর তিনটে লাইন হেনরিকে আরো প্রিয় করে তুলেছিল। ‘The spirit of Bukowski is walking the cobblestone streets of Sweden, alive between the lines of Henry Denander’s poetry. Everyday struggles and triumphs of being human knows no international boundaries here’.  







ওখান থেকে সোজা হোটেল। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এ এফ চ্যাপম্যান-এ। একটা ছোট্ট দ্বীপ Skeppsholmen-এর সমুদ্রের খাঁড়িতে এই জাহাজটি দাঁড়িয়ে আছে। এক্সময় সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এই জাহাজকে এখন হোটেলে পরিণত করা হয়েছে। যেখান থেকে হেঁটে যাওয়া যায় শহরের কেন্দ্রস্থলের কালচারাল সেন্টারে যেখানে আমার কবিতা পাঠ হওয়ার কথা। আমার জন্য বরাদ্দ হলো একটি কেবিন। এবং আমার থাকার খরচ কামিনী প্রেস দেবে ঠিক হয়েছে শুনলাম। স্টকহোমের এই কামিনী প্রেস কবিতার মিনি বই ছাপে। হেনরি দিনানদার নিজের হাতে এই বুটিক বইগুলো ছেপে বাঁধাই করে। ইংরেজিতে কবিতা লেখে। ছবি আঁকে। গিটার বাজায়।
ঘরের চাবির বদলে আমার হাতে রিসেপশন থেকে ধরিয়ে দেওয়া হলো একটা কার্ড। ক্রেডিট কার্ডের থেকে একটু বড় সাইজের। ওটাই নাকি চাবি। কি-কার্ড। এ পারের লোহার দরজায় লকের উপর কার্ড ঢোকানোর একটা স্লট। কার্ড ঢুকিয়ে ঘটাং করে দরজা খুলে একটা ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে সোজা জাহাজের ডেকে। জাহাজের ডেকে দেখি আমার আরেক বন্ধু বোয়েল তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার কার্ড ঢুকিয়ে ডেক থেকে নীচে জাহাজের খোলের ভেতর নেমে একতলা ঘরটায় ঢুকলাম সবাই, তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে রওনা দিলাম আমার জন্য বরাদ্দ করা ঘরটার দিকে। পর পর সার দেওয়া ঘরের উপর নম্বর লেখা আছে। দু নম্বর ঘর আমার। কামিনী প্রেসের সদ্য প্রকাশিত মিনি কবিতার চ্যাপ বুক র‍্যাপিং পেপারে মুড়ে হেনরি নিয়ে এসেছে আমার জন্য। ব্যাগ খুলে কোলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া গ্রাফিত্তির বইপত্তরগুলো এবার ওদের হাতে তুলে দেওয়ার পালা আমার। এসবের মধ্যে বোয়েলের মিষ্টি ছোট্ট মেয়েটা আমাকে একটা পেঙ্গুইনের লকেট হাতে দিলো। লাকিচার্ম। স্টকহোমে পাওয়া আমার সেরা উপহার।
বোয়েল বলল, ‘চেঞ্জ করে নাও। তারপর আমরা ডিনারে যাবো’।
সন্ধ্যেবালা ডিনার খাওয়ার সাহেবী অভ্যাস আমার নেই। এ ব্যাপারে আমি নিতান্তই পাতি বাঙালি। দেরি করে বেধড়ক খেয়ে রোজ সকালে মুখ টকে যায়। রাত এগারোটা বারোটার আগে খিদে চাগাড় দেয় না। অতয়েব আমার প্রিয় এক কাপ কালো কফি খেয়ে আমি ডিনার সারলাম।
‘জাস্ট এক কাপ কফি? আর কিছু খাবে না তুমি? আমরা কিন্তু খাওয়া দাওয়া করব’।
‘করোনা, অসুবিধে নেই। আমার খিদে নেই। তোমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই কফি’।







কাচের বেঁটে গ্লাসের ভেতর থেকে থর থর করে কাঁপছে মোমবাতির আলো। আরো কতগুলো হলুদ আলো পড়েছে টেবিলটার উপর। হোটেলের ভেতরটা বেশ গরম। গায়ের চামড়ার জ্যাকেটটা চেয়ারে চাপিয়ে কিছুটা সহজ হওয়া গেল। টেবিলের বাঁদিকটা কাচে মোড়া। এখানে বসেই বাইরের সমুদ্রের খাঁড়িটা দেখা যাচ্ছে। একটা জাহাজ খুব ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে অন্য আরেকটা দ্বীপের দিকে।
‘কালকে আমায় কী করতে হবে’?
‘তুমি কী করতে চাইছ’?
‘মানে আমার সাথে আমাদের শর্ট ফিল্মগুলো আছে। যে কোনো একটা শর্ট ফিল্ম দিয়ে আমরা অনুষ্ঠান শুরু করতে পারি’।
‘ঠিক আছে। কাল তোমার অনুষ্ঠান ছটা থেকে। তুমি এখন বিশ্রাম নাও। কাল বিকেল চারটেতে দেখা হবে আবার’।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে বোয়েল আর আমার মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল সেগুলো নিয়ে ভাবছিলাম আমি। আরেকবার আমার ব্যক্তিগত নোটস-এ চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। এমনিতেই স্টেজে উঠলে কথা খুঁজে পাই না আমি। মানে একটা বৈদিক মন্ত্র দিয়ে শুরু করলে খারাপ হয় না। ওয়েস্ট ল্যান্ড খানিকটা সাহায্যে আসতে পারে হয়ত। মানে এমন কিছু দিয়ে শুরু করা যা সবাই জানে আরকি। আর ভাবছিলাম সেই প্রশ্ন উত্তরের কথাগুলো যা আমার আর বোয়েলের মধ্যে দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। ওদিকে আরো একটা সাক্ষাৎকারের জন্য বহু দিন প্রশ্ন পাঠিয়েছে সাউথ আফ্রিকান কবি গ্যারি কামিস্কি তার ডাই হার্ড ইন্টারভিউস-এর জন্য। বেশির ভাগ প্রশ্নই প্রায় একই রকম। তাই বয়েলকে পাঠানো উত্তরগুলো ওকেও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। যা ইয়োরোপ থেকে ফিরে আসার পর প্রকাশিত হয়। এবং পরে বোয়েলের কাছে জানতে পারি এই সাক্ষাৎকারটা সুইডিশ অনুবাদ হয়ে পোস্টস্ক্রিপ্টামে প্রকাশিত হবে।  


------------
Painting By Henry Denander              




Monday, September 10, 2018

কোলকাতা – মুম্বাই – ইস্তানবুল – স্টকহোম /প্রথম পর্ব

ইস্তানবুল হয়ে প্লেনটা ঢুকে পড়ল একটা ঘন মেঘের ভিতর। ছাই সবুজ এরকম মেঘ আগে কখন দেখিনি। কলকাতার বত্রিশ ডিগ্রি থেকে সোজা শূন্য তাপাঙ্কের স্টকহোমে নেমে পড়লাম। খানিকটা নার্ভাসনেশখানিকটা উত্তেজনাখানিকটা আকাঙ্ক্ষার চড়া পারদ ওঠা নামা করছিল শিরদাঁড়া বরাবর। ইয়োরোপে এই প্রথম, তাও একা একা। বই ভর্তি গন্ধমান ব্যাগটার কথা ভাবতেই ভয় করছিল। তাই ভাবা বন্ধ করে আশেপাশের সুন্দরী কন্যাদের দিকে মনোযোগের যোগব্যায়ামে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।
আমেরিকান বন্ধু, কবি এরিক ভাটনে বলেছিল বটে যে, ইস্তানবুলটা ঘোরা দরকার। ওটা একটা ম্যাজিকাল শহর। ইয়োরোপের বুলন্দ দরওয়াজা। কিন্তু ইস্তানবুলের এয়ারপোর্ট ছাড়া ট্রানজিটের কয়েক ঘন্টায় আর কিছু দেখা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া ইস্তানবুলে তো কোন বন্ধুও নেই যে, তার হাত ধরে ওরহান পামুকের শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ব। কলকাতায় অবশ্য আগেই দেখে ফেলেছিলাম ফতিহ  আঁকি-র (Fatih Akin)  ফিল্ম Auf der Anderen Seiti,  অন্য পাশটায়। ইউকে রিলিজের সময় যার নাম দেওয়া হয়েছিলস্বর্গের কিণারায়। অবশ্য আমার জার্মান নামটাই সঠিক লেগেছিল, পরের কাব্যিক নামটার থেকে এই তুর্কি-জার্মান পরিচালকের এই ফিল্ম ছিল জার্মান আর তুর্কির ভেতরকার চাপা উত্তেজনা নিয়ে।  প্রথম আর দ্বিতীয় প্রজন্মের তুর্কি-জার্মানদের ভেতরকার ফাঁক আর টানাপোড়েন নিয়ে। নিজের সঠিক পরিচয়ের খোঁজ আর পুরোনো দেশটার প্রতি টান নিয়ে, যখন ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়ানে নাম লেখাচ্ছে তুর্কি।

ইস্তানবুলের রাস্তায় কতগুলো বাচ্চা ব্যাগ ছিনতাই করছে এবং তাদের তাড়া করে যাওয়া মেয়েটিকে শেষ অবধি বাচ্চাগুলো জাস্ট গুলি করে মেরে দিচ্ছে দেখে একটা চাপা অস্বস্তি আমার ভিতর ভিতর কাজ করছিল,থাকঅন্য আরেক সময় আসা যাবে ইস্তানবুলে। যদিও তুর্কি ক্লাসিক্যাল মিউজিক আমার গোটা প্লেন-পথের সঙ্গি ছিল। ইচ্ছেও হচ্ছিল ইস্তানবুলে ক্লাসিক্যাল মিউজিক শেখানোর সব থেকে নাম করা Uskudar Musiki Cemiyeti  দেখে আসার। দেখে আসা সেইসব লম্বা গলা তানবুরআউদকুডুম ড্রাম ইত্যাদি। বেটোভেনের ন নম্বর সিমফনিতেও তো এই তুর্কি ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবহার আছে। এবং মোর্জাটও তাঁর অপেরায় তুর্কি থিম ব্যবহার করেছিলেন। সিমফোনি অর্কেস্ট্রায় আজ ব্যবহৃত মন্দিরা (করতাল)ঘন্টা তো এসেছে তুর্কিদের হাত ঘুরেই। সেই অটোমান সাম্রাজ্যের হারেম মিউজিক থেকে শুরু করে আজকের এই ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়ানের হাত ধরা আধুনিক তুর্কিস্থান এবার আর দেখা হলো না আমার। শুধু ঝকঝকে ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে ভারতীয় টাকা ভাঙ্গাতে গিয়ে দেখলাম সেটা ভাঙ্গানো গেলো না।  

১৭ই নভেম্বর ২০১০


জঙ্গলে সবুজ হয়ে থাকা সুইডেনের ঝকঝকে শহর স্টকহোমে আমার কবিতা পাঠ, কবিতার ওয়ার্কশপ ইত্যাদি। গত একবছর ধরে আমার কয়েকজন সুইডিশ কবি বন্ধু চাইছিলেন আমি ওদের ওখানে গিয়ে কবিতা পড়ি। কিন্তু আমার মতো একজন স্ট্রিট পোয়েটের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু খরচ সাপেক্ষই নয় প্রায় অসম্ভব ছিল। প্লেনের ভাড়াই তো প্রায় আধ লাখ টাকার মতো, তার উপর থাকা খাওয়া। ইয়োরোপের অন্যান্য শহরের তুলনায় স্টকহোম খুবই এক্সপেন্সিভ। অতএব আমার কবিতা নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে একথা তাদের জানাতেই তারাই নেমে পড়ল কীভাবে আমাকে স্টকহোমে নিয়ে যাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে। আমার আরো একটা আবদার ছিল। রিটার্ন টিকিটটা যেন এক মাস বাদের হয়। অর্থাৎ কিনা এযাত্রায় আরো কটা দেশ ঘুরে ফেলা। এবং শেষ অবধি লটবহর সমেত এই বঙ্গ সন্তান ১৭ই নভেম্বর ২০১০-এর সন্ধ্যায় স্টকহোমে। প্লেন থেকে নামতেই প্রাথমিক তীব্র ঠাণ্ডার ঝটকাও মন ভালো করে দিচ্ছিল, ভালোই লাগছিল এয়ারপোর্টের গেট পেরোতে পেরোতে। 
মিস্টার ব্লু ইজ ওয়েটিং ফর ইউ। মিস্টার ব্লু আমার জন্য অপেক্ষায়। এতদিনের ভারচুয়াল বন্ধুত্বের পর এই রিয়ালিটির কোলাকুলি স্বপ্নের মতো যেন। ২৬ কিলোর ব্যাগটার টলমল অবস্থানের হ্যাঁচকা, হাতের আঙুলে ক্সলশিটে ফেলে জানান দিলো গ্রাউন্ড রিয়ালিটির কথা।
এই মিস্টার ব্লু বা নীল মানুষের একটা আলাদা গল্প আছে। হেনরি দিনানদার একজন সুইডিস কবি। আমার অনেক দিনের বন্ধু। এথেন্সের কাছে হাইড্রা বা হুইড্রা (আমি জানতাম হাইড্রা কিন্তু পরে হেনরির মুখে শুনলাম স্থানীয় লোকজন ওই দ্বীপটাকে আদর করে ডাকে হুইড্রা) আইল্যান্ডে ওর একটা ছোট্ট বাড়ি আছে। সঙ্গে ছবি আঁকার স্টুডিও। এবং লাগোয়া একটা পুরোন বইয়ের দোকান। যেটা ও যখন ইচ্ছে হয় তখন খোলে। পুরো দ্বীপটাতেই কোনো গাড়ি চলে না। আছে জল-ট্যাক্সি যা দ্বীপের চারদিকে সমুদ্রে পাক দেয়। আর মাল বওয়ার জন্য সারিসারি গাধা। গাঢ় নীল সমুদ্র ঘেরা এই দ্বীপটাতে মাঝে মাঝে গিয়ে থাকে হেনরি। ছোট ছোট বাড়ি ঘেরা, পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তারা চলে গেছে এদিক ওদিক। নেটে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখে এই হুইড্রার প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। সেই সময়ই দুটো বই হাতে এলো। একটা হেনরির। কামিনী প্রেস প্রকাশিত কবিতার মিনি বই ‘দা পোয়েট্রি অফ মিস্টার ব্লু’ আর অন্যটা সাউথ আফ্রিকান কবি গ্যারি কামিস্কি আর এভা কোয়ালস্কা সম্পাদিত ডাই হার্ড প্রেসের ‘হু ওয়াজ সিনক্লেয়ার বেলেস’। এই সিনক্লেয়ার বেলেস একজন সাউথ আফ্রিকান কবি। ১৯৬০-এ উইলিয়াম বারোজ, গ্রেগরি করসো, ব্রায়ান জিসিন-এর সাথে এক সাথে লিখেছিলেন সেই প্রবাদ প্রতিম কাট আপ উপন্যাস ‘মিনিটস টু গো’। বাকি আমেরিকান কবিদের মনে রাখলেও এই কবিকে কেউ মনে রাখেনি। কেন তিনি সাউথ আফ্রিকান বলে? আজ ২০১০এ এসে গ্যারিকে বই করতে হচ্ছে, ‘হু ওয়াজ সিনক্লেয়ার বেলেস’। প্যারিসে লোকজন তাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসেছে আবার। ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিতে পেরেছে গ্যারি।
১৯৫০ নাগাদ তার জন্মস্থান উগানডা থেকে প্যারিসে চলে আসেন সিনক্লেয়ার। অলিম্পিয়া প্রেসের সম্পাদক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। থাকতেন সে সময়ে বিট হোটেলে। যেখানে তখন বারোজ, জিসিন, করসোদের আনাগোনা। আড্ডা। বারোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ সম্পাদনার কাজও তিনি করেছিলেন।
তা এই বইটা থেকে হাইড্রা সম্বন্ধে আরো কিছু তথ্য আমাকে উসকে দেয়। পরে জানতে পারি আমার অন্যতম প্রিয় গায়ক লিওনার্ড কোহেনের একটা সময় কেটেছে হাইড্রায় আড্ডা মেরে। উপন্যাস লিখে। আর হেনরির প্রতিবেশী এখন কোহেন। হেনরির একটা কবিতা আছে এটা নিয়ে।




আমাদের মধ্যে একজনের তো ভুল হতে পারে না

আমি খুব স্বপ্ন দেখছি, প্রায় প্রত্যেক রাতে আর গত রাতে আমার সাথে দেখা হয়ে গেল লিওনার্ড কোহেনের অ্যান্টিবস স্কোয়ারে, একটা ছোটো ফ্রেঞ্চ শহর নিসের ঠিক বাইরে, উনি খুবই আমায়িক আর ওঁর মনে ছিল সেই বইটার কথা যেটা আমি ওনাকে পাঠিয়ে ছিলাম আর অবশ্যি একভাবে দেখতে গেলে আমরা তো প্রতিবেশী গ্রিসের ওই ছোট্ট দ্বীপটার আর উনি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন ওঁর ফ্ল্যাটে যেখানে উনি থাকছিলেন, আর ঠিক দরজার বাইরে দেখি ওই উঁচু সিড়িগুলো পেরিয়ে, আমাদের দেখা হয়ে গেল আমার পুরোন বন্ধু একের সাথে, আমরা বিশ্বাস্ করতে পারছিলাম না, কী অদ্ভুত যোগাযোগ আর সেও লিওনার্ডের একজন বড় ফ্যান আর যখন ওকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো ফ্ল্যাটে ও খুব অবাক হয়ে গেল আর কিছুক্ষণ পর একে জড়তা কাটিয়ে উঠল আর তখন লিওনার্ড আমাদের কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তাকে থামিয়ে একে শুরু করল পুরোন চুটকি আর গল্প বলা, লিওনার্ড এতটাই অমায়িক আর মম্র স্বভাবের যে তিনি ওকে বলত দিলেন আর হাসতে লাগলেন কিন্তু শেষমেশ দেওয়াল থেকে নামিয়ে আনলেন তাঁর পুরোন গিটার, গিটারটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সংস ফ্রম এ রুম-এর কাভারের ছবির মতো, ওটা ঝোলানো ছিল তাঁর হাইড্রা বাড়ির দেওয়ালে যেখানে জানালার ধারে বসে থাকে মারিয়্যান আর অ্যান্টিবস-এর বাড়িটাও দেখতে একই রকম, সব সাদা আর লিওনার্ড তাঁর গিটারের তারে আঙুল চালাতে শুরু করলেন এমনকি একেও চুপ করে গেল আর হঠাৎ লিওনার্ড গাইতে শুরু করলেন আর আমি ভাবলাম কী অসম্ভব একটা মুহুর্ত আর আমি কীভাবে লিওনার্ডের কাছে বসে আছি আর উনি গাইছেন 'দা স্ট্রেঞ্জার সং' তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আর তারপর হঠাৎ একে গলা মেলাতে লাগল তেড়ে একটা মাতালের মতো আর সেখান থেকে আমার স্বপ্নটা এগিয়ে চলল আর কীভাবে যে সেটা শেষ হলো আমি মনে করতে পারছি না, যদি সত্যি তা শেষ হয়ে থাকে, হয়ত ওরা এখনো গেয়ে চলেছে সেই ঘরটায় যেটা প্লাস অ্যান্টিবস-এর সামনে।         

হেনরি মিলারের গ্রিস নিয়ে লেখা বইটাও আরেকবার উলটে পালটে দেখি, দা কলোসাস অফ মারুসি। এই সময়ে আমার চারদিকে কতগলো অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। সেই ঘটনাগুলোকেই জাস্ট শব্দের ভেতরে আঁটকে রাখি আমি – ‘অজয়ের পাড় ধরে জয়দেব কোথায় যে হেঁটে চলে গেল’ কবিতাটায়। যার একটা ইংরেজি ভারসানও করেছিলাম মূলত হেনরির প্রোরোচনায়।

অজয়ের পাড় ধরে জয়দেব কোথায় যে হেঁটে চলে গেল

জয়দেবের মিষ্টি দোকানটা আর নেই। মুদিয়ালী বাড়ির জিন রমণীর সাথে সে যে কেন গেল হাইড্রায় মিষ্টি বেচতে!!! কেন যে যায় সবাই কোথায় যে যায়। আসলে থাকার মধ্যেও একটা যাওয়া কাজ করে।
সমুদ্র নীল আছড়ানো একটা ফুলের নাম হাইড্রা। হারকিউলিস যে নমুখো জলের জানোয়ারটাকে মেরেছিলো, মেরেই তো ফেলেছিলো প্রায়। শুধু অমর একটা মাথা কেটে কোথায় যে পুঁতে রেখেছিলো। কোথায় যে? স্মৃতির ঝাপসারা শব্দেরা ফুটে আছে মদ গলানো এই সাইক্লোপিয়ান পাথর আর ঘাসের জড়াজড়ি হাওয়ায়।

  মেয়েটা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে চুমু আর চুমু। জড়ানো অস্তিত্বরা ধীরে ধীরে পিট পিট করে আরাম পেতে থাকে। আঙুলের নিশপিশ আর সর্বনাশ আমি ভুলে যেতে থাকি। কে আর জানতো এটা স্রেফ নমস্কার শুধু। এরকমই হয় পাশের বাগানে সূর্য উঠলে ওই লেবু গাছটা বরাবর। না না ওটা অলিভ নয় আমি জানি। মদ আর টকচানো অলিভে জিভ জড়িয়ে মড়িয়ে পরিত্রাহি কতবার।

পোকা মারার মরণ সঙ্গীত গেয়ে ওই রমণীদঙ্গল ওষুধ ছড়ায় না এইখানে। এখানের মরণের গান শুধু একটা পাহাড় থেকে ছুটে আরেকটা পাহাড়ের মাথায় এক দমে উঠে যাওয়া শুধু আর আছড়ানো জঙ্গী চুলের ঢেউয়ে বারবার শরীরের পোকাগুলোর চোরাচালান। নীল-সাদার এই দেশে তাই মিস্টার ব্লু হয়ে পড়া সোজা। তাতো হেনরি দিনানদার জেনেছিলো। কীভাবে মাথার ভিতর থেকে কবিতার শব্দগুলো হঠাৎ চলে গিয়ে রঙ হয়ে ধরা দিতে পারে অন্য কোথাও। তা মিস্টার ব্লুও জানতো না। অথচ সব খোঁজ সে মেয়েটার ছিল। আর জেনেছিলো হেনরি মিলার। সেই চুপ। A pause in the musical score of creation by an expert calligrapher.

আমার অ্যাকোরিয়ামের মিষ্টি মাছটা যে আমাকে খুব ভালোবাসত আজ দেখি হঠাৎ সে নেই। কেন যে যায় সবাই কোথায় যে যায়। আসলে যাওয়ার মধ্যেও একটা থাকা কাজ করে। আসলে পাথরগুলোই সব পাগল, ওই সব ম্যাজিকাল আলোতে থেকে থেকে পাথরত্ব খুইয়ে ফেলেছে অজান্তেই। হৃদয়ের বদলে তাই এক আলো খেলা করে। সে নেই অথচ সে চুল খুলে চেয়ারে বসে থাকে রোজ। মাথা নিচু করে এক মনে ভাবে। আমি তার দিকে তাকাই না পাছে ফের বিরক্ত হয়ে চলে যায়। মিষ্টি মাছটার সাথে ভেসে ভেসে। অথচ সেও তো চুমু চেয়েছিলো একদিন। কাঁঠাল চাঁপারও পেকে উঠে ফুটে উঠতে বেশ খানিকটা তীব্র রোদের প্রয়োজন হয়। এই সব গাছেরাও জানে, জানে সেই মৃত্যুর পাগলামো। ঘেন্নার ছেলেমানুষি ছেলেখেলা। তাকে কী করে ডাকি এই অন্ধকারে সে কি আর পথ খুঁজে পাবে? যেন পথ খুঁজে পেলে বেঁচে যাবে এই অন্ধকার ভালোথাকাগুলো।

মদ বেচতো যে লোকগুলো তারাতো জানতো শব্দ পাগলদের তীব্র তৃষ্ণা শিকড়ের চোঁচোঁ আর্তির মায়া তারা কীভাবে কাটাবে। সবাই তো তাই ভাবে সব কিছু জানে আসলে কিছুই জানা যায় না কোনোদিন। কারণ কিছুই জানার কোনো দরকার নেই। কিছুই চেনার কোনো দরকার নেই। ট্যাবলেট খেতে খেতে ট্যাবলেট না খাওয়ার মন্ত্রণা তাকেও দিতে হতে পারে একদিন। ভালোবাসতে গেলে  না ভালোবাসাটাও আগে শিখে নিতে হয়। শব্দতার রক্ষাকবচ হবে বলে সর্বনাশ রোজ আসে কবচ ভিক্ষা করে নিতে। নিয়ে যায় নিয়ে যেতে থাকে সমস্ত না পারাগুলো, বাস্তবতা, প্রতিজ্ঞার শব।

আকাশের অনেক লাল আর চোখ ভরতি নীল নিয়ে একটা আস্ত সন্ধ্যা নামছে ফ্ল্যাটের উপর। ফ্ল্যাটটা কি ঢাকা পড়ে যাবে সন্ধ্যায়!! আর যে রমণী আমার জন্য বৃষ্টি নাচ নাচছে তার শুকনো বাগানে হাজার সমুদ্র পেরিয়ে তাকে বোলো এখানে বৃষ্টি পড়ছে খুব। শান্তিতে ঘুমোচ্ছে ক্লান্ত কুকুর দুটো, উকুনের কুটকুটগুলো আর আমার সারা শরীর বেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে মিষ্টি মাছেদের অমরত্ব আর সেইসব আলোর পাগলামি। 

  


Monday, June 25, 2018

কথায় কথায় শুভঙ্কর দাশ


দেশপ্রিয় পার্ক ছাড়ালে একটু এগোলে, ডানদিকে গলির ভিতর ফ্ল্যাট। পাঁচতলার টঙের ঘরে উঠতে গিয়ে যা সিঁড়ি ভাঙলাম – জিভ বেরিয়ে গেল এই ঠাণ্ডাতেও। হাফ বোতল জল খালি করে একটি সিগারেট ধরিয়ে বসলাম শুভঙ্করদার মুখোমুখি। বললাম – সাক্ষাৎকার চাই। শুভদা বলল – ধুস, ওসব ছাড় – চল আড্ডা মারি। শুরু হলো আমাদের আড্ডা। গ্রাফিত্তির ঠেকবাজি। আড্ডার সমস্ত কালো সমেত একটা কথাবার্তা রইল এখানে।

শুভঙ্করদা তোমার লেখালিখির বয়স প্রায় ছাব্বিশ বছর – এই জার্নিতে প্রথম দিকের ভাবনা থেকে আজকের ধারণায় কতটা ফারাক এসেছে?

-ধারণায় পরিবর্তন তো এসেছেই। মানুষ তো পাল্টায়, আরকি, এখন চেষ্টা করি কবিতাকে
যতটা সহজ করা যায়, একটা communication –এর জায়গা তৈরি করা। আগে মনে হতো 
communication  জরুরি নয়। জার্নিটা খুব জরুরি, না হলে আজ যেভাবে ভাবছি সেভাবে
ভাবতে পারতাম না। এখন মনে হয়, কবিতায় শব্দের জাদুকরি দেখিয়ে কোনো
লাভ নেই। সরাসরি নিজেকে যতটা express  করা যায়।

এখান থেকে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে আসছে। অনেকেই বলেন – কবিতা নিজস্ব ব্যাপার। Communicate করা জরুরি নয় – তুমি কী বলছ?

-আমি এসব মানি না। মানি না এ কারণে – নিজস্ব হলে লিখে ট্রাঙ্কে রেখে দিক।
পড়াচ্ছে কেন? ছাপানোর কী প্রয়োজন? আমার কথাই বলি – আগে আমি একটা
জিনিস করতাম, একটা experimentation – একটা শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে অন্য জায়গায়
যাওয়া। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেখেছি সেটা বেশির ভাগ লোকের মাথার উপর
দিয়ে যাচ্ছে, ওই feelingsটা সে ধরতেই পারছে না। অনেক সহজেই ওটা বলা যায়।
কিন্তু আসলে একজন কবি এটা করার সময় ভিতরে যেটা কাজ করে তা হলো
– আমি কতটা জানি। এই যে জ্ঞান দেওয়ার প্রবণতা, এটা সব জায়গাতেই আছে।
এই করতে গিয়ে এখন সারা পৃথিবীতেই কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে।
‘ওরে বাবা কবিতা – ও তো কিছুই বুঝব না’, এটাই পাঠক বলছে। এতে লাভ
কী হলো? পাঠক হারালাম আমরা। একটা উপন্যাসের যত পাঠক, কবিতার তত
নেই – কেন? কারণ এটাই। কবিতা আর পরীক্ষার খাতা এক নয় যে কতটা জানি
জাহির করব।

অনেক কবি বলেন – ফর্ম না কন্টেন্ট এই প্রশ্নে তারা ফর্ম নিয়ে ভাবেন বেশি – তোমার কী মত?

-আমার মতে দুটোই জরুরি। আমি যখন লিখছি, আমি তো কিছু একটা করতে চাইছি।
কন্টেন্ট-ই নেই, একটা ফর্ম নিয়ে কী করব আমি? এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট কমবেশি
সব দেশেই হয়েছে। ফর্মটাই কন্টেন্ট বলা-টলা ইত্যাদি। এসব আঁতলামো তে বিশ্বাস নেই
আমার।

বাংলা সাহিত্যে এবং অন্যান্য সাহিত্যেও দেখা যায়, অনেকে তাদের কবিতাকে Anti-poetry  বা না-কবিতা বলছেন। অথচ একজন পাঠক কিন্তু সেটাকে অন্তত পড়া শুরু করার সময় কবিতা ভেবেই পড়ছেন। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত না?

-প্রায় সব কবিতা movement এই এরকম কিছু না কিছু হয়েছে। এটা আসলে চোখে আঙুল
দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা –‘দেখো আমি স্রোতের থেকে আলাদা’। Ultimately কবিতাটা কবিতাই।
হ্যাঁ কবিতা – না কবিতা ওসব কিছু না। একটা কবিতা যখন আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে
তখনই সেটা আমার কাছে কবিতা। না হলে আমি পড়বই না। তা সে অ্যান্টি পোয়েট্রি
হোক, নতুন কবিতা হোক, কংক্রিট পোয়েট্রি হোক, মিট পোয়েট্রি হোক, যা হোক...

আশির দশকে শুরু হয় গ্রাফিত্তির লড়াই। লড়াই ব্যবসায়ী কাগজের বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠানে তাঁবেদারির বিরুদ্ধে। আজ ২০১৪এ দাঁড়িয়ে কী মনে হচ্ছে – লড়াইটা কি আজও সমান প্রাসঙ্গিক?

-এস্ট্যাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই এটা তো প্রাসঙ্গিক বটেই। সময় পালটেছে – পরিস্থিতি
বদলেছে কিন্তু ব্যাপারটা একই থেকে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিকতা আরও ছড়িয়েছে, আরও
অন্যরকম হয়েছে। তার রূপ পালটেছে। তখন একটা বা দুটো হাউস পুরো বাংলা
বাজারটা দখল করে রেখেছিল। তারা যাকে কবি বা লেখক বলত – তারাই কবি বা
লেখক। আর বাকিরা কেউ না। একটা জিনিস খুব চালাকি করে প্রচার করা হয়েছিল,
যে লিটল ম্যাগাজিন শুধুই হাত পাকাবার আসর। এখন্ সেটা আর ওভাবে নেই।
আনন্দবাজার বা দেশ-এর এই চাপা কন্ট্রোল এখন আর নেই। এখন তো দেশ-এ লিখতে
লেখকরাই আর interested  নয়। পড়া তো দূরের কথা। এখন সিনারিওটা অন্য।
এখন ব্যাপারটা ব্র্যান্ডিং-এর উপর নির্ভরশীল। আমি কী জামা পরব, কোন ব্রাশ দিয়ে
দাঁত মাজব, অন্যে ঠিক করে দেয়। আমি তো শিখেছিলাম ছোটোবেলায় দর্জির কাছে
গিয়ে জামা বানানো, এখন ওসব আর প্রায় নেই। এটা আরও ভালো বুঝেছিলাম ইয়োরোপে
গিয়ে। প্রায় সব শপিং মলেই একই ব্র্যান্ড, বিশ্ব মার্কেটটা open হয়ে যাওয়ায় একই জিনিস
সব জায়গায় পাওয়া যায়। আমি কলকাতায় বসে নরওয়ের জামা পরতে পারি। তাহলে
ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে আমি সারাক্ষণ monitored হচ্ছি। আমার চুল কাটা ঠিক করবে তারা,
প্রতিষ্ঠানের এই খেলা খুব সূক্ষ্মভাবে মানুষের স্বাধীন চিন্তা কেড়ে নিচ্ছে। বাজার ঠিক
করছে – সমাজে তুমি কীভাবে থাকবে তার normsগুলো। তার বাইরে গেলে হয় তুমি
বাউন্ডুলে নয় সমাজবিরোধী। ফাল্গুনীর (ফাল্গুনী রায়) কথা মনে পড়ে গেল, একটা
ছেলে বিবাহযোগ্য কিনা depend করে তার purchasing power-এর উপর। পয়সা আছে? না
থাকলে বিয়ে হবে না। কে মেয়ে দেবে তাকে? সমাজ কি খুব পালটেছে? ফাল্গুনী সত্তরে
বলেছিল – পয়সা না দেখালে মেয়ের বাবা বা বেশ্যার দালাল কেউই মেয়ে দেয় না।
কিছুই তো বদলায়নি। তাই লড়াইটা থাকবেই।

এখন তো দেখি পাড়ায় পাড়ায় লিটল ম্যাগাজিন। তবে কটা যে আসলেই লিটল ম্যাগাজিন – বোঝা খুব চাপ। এতে কি সামগ্রিক ভাবে লিটল ম্যাগাজিনের জায়গাটা নষ্ট হচ্ছে না?

-আমার সেটা মনে হয় না। কারণ কাজটা হোক, চেষ্টাটা চলুক। সবাই হয়তো পারবে না,
কিন্তু একজন দু’জন তো বেরিয়ে আসবে। জীবনানন্দ বা ফাল্গুনী রায় কি দশটা বিশটা
হয়েছে!!! হয়নি। কিন্তু চেষ্টাটা দরকার।

কিন্তু কোথাও গিয়ে তাহলে একটা সমস্যা তো উঠে আসছে, যারা লিখছে তাদের তো selective  হতে হবে, নাকি randomly  যেই লেখা চাইল দিয়ে দিলাম?

-হ্যাঁ সেটা তো হতেই হবে। স্যুভেনির মার্কা কাগজে লেখা দিয়ে কী লাভ।বা পঞ্চাশ ফর্মার
একটা কাগজ – সেখানেও লেখা দিয়ে লাভ নেই। কেউ পড়বে না। যারা লিখছে – তারা
শুধু নিজের লেখাটা ছিঁড়ে নিয়ে ফাইল-আপ করে রাখে। বাকিদের লেখার দিকে তাকায়
না।

তোমরা যখন আমাদের মতো ছিলে মানে আমাদের বয়সে, যখন যুবক তোমরা...
(কথা থামিয়ে দিয়ে) আমি এখনও যুবক (হা-হা হাসি)। না না বল কী বলবি।

তখন কোনো লিটল ম্যাগাজিনে কেউ একটা ভালো লিখলেই কথাটা হাওয়ায় ছড়িয়ে যেত। অথচ তখন ইন্টারনেট ফেসবুক ছিল না। তবু এটা ঘটত। আজ এত কিছু থেকেও সেটা তেমন ঘটছে না। এর কারণ কী মনে কর?

-তা নয়, আসলে আমার মনে হয়, এখন একে অপরের প্রতি respectটা কেমন যেন কমে
গেছে, মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। respect  মানে শুধু বয়স্ক লোককেই respect  নয়, একটা young
  ছেলেকেও respect  করা যায়। তার লেখাকে respect  করা যায়। নিজের লেখা ছাড়া অন্যের
লেখা পড়ব না – এই মনোভাবটাই এখানে সমস্যার অন্যতম কারণ। এটা নিয়ে কথা
হওয়া জরুরি। ভালোবাসাবাসি কম হয়ে যাচ্ছে? এত ruthlessness  কেন?

সেটাই, মানে বাংলা সাহিত্য কি এখন শুধুই নিজের বা নিজ গোষ্ঠীর পিঠ চুলকানোর জায়গা হয়ে দাঁড়াল?

-পিঠ চুলকানো চিরকালই ছিল, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন জগতে এতটা ruthlessness  ছিল না
বোধহয়। মানে কেউ কাউকে মানি না। আমরা যেমন, ধরা যাক সুনীল গাঙ্গুলিকে
গালাগাল দিলে, তার লেখাটা পড়ে তবেই গালাগাল দিতাম। না পড়ে দিতাম না। ভালো
লাগছে না, আর পড়লাম না। কিন্তু তার সাথে দেখা হলে হাসব না বা অপমান করব –
এর কোনো যুক্তি নেই আমার কাছে। মেনে নিতে না পারলে সরাসরি কথা বলেছি,
ডিসকোর্সে গেছি, কাজের জাস্টিফিকেশন খুঁজেছি। যেমন আবার নাম করেই বলছি, উদয়ন
ঘোষকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘নিজেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী বলছেন অথচ বড়ো
কাগজে লেখার চেষ্টা করছেন, কেন? তাহলে কি আপনি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নন’? তখন
উদয়ন ঘোষ নিজমুখে বললেন – ‘না, আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নই’। তখন বললাম –
‘এটা তো আপনার আগে বলা উচিত ছিল’। কিন্তু তা বলে আমরা তো লোকটাকে
অসম্মান করিনি। তার পরেও আড্ডা মেরেছি। এখন তো আদান-প্রদানের জায়গাটাই
নেই।

উদয়ন ঘোষের কথা ওঠায় মনে পড়ল – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কেও লিটল ম্যাগাজিনের প্রিন্স বলা হতো। কিন্তু তিনিও আজকালে লিখতেন। এই নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, প্রথমত লিটল ম্যাগাজিন তাকে উপন্যাস ছাপার জায়গা দেয় না। দ্বিতীয়ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যারা লড়ে তারাও কোথাও একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়। সুবিমল মিশ্রও শেষ জীবনে প্রতিষ্ঠানের হাত ধরলেন – এগুলো নিয়ে তোমার কী বক্তব্য?

-দেখ, সন্দীপনদার সাথে আমরা খুব ক্লোজ ছিলাম, দিনের পর দিন আড্ডা হতো।
সন্দীপনদা ওনার মিনি বুককে মনে করতেন লিটল ম্যাগাজিন। এছাড়াও সন্দীপনদা প্রচুর
লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছেন। তবু আমি সন্দীপনদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘এটা কেন
করেন’? সন্দীপনদা বলেছিলেন – ‘ভাই দশ হাজার টাকা পাই, সংসার তো চালাতে হবে’।
ভাব, অতবড়ো একজন গদ্যকার, আনন্দবাজার দিল কিছু সম্মান? আজকালে লিখতেন –
যেটা সেভাবে কোনো সাহিত্যের কাগজই নয়। শুধু পুজো সংখ্যা বেরোত।
আর সুবিমলদার প্রথম যে জায়গায় আমি বিরোধিতা করেছিলাম, সুবিমলদার একটা
ইংরেজি বই বেরোয়, যেটা আমার বন্ধু শ্রীধর অনুবাদ করে। বইয়ের ব্যাক কভারে লেখা
ছিল – one and only anti-establishment writer in Bengali literature’.  শ্রীধরকে বললাম – ‘এটা কী
হলো’? শ্রীধর বলল – ‘আমি কিছু করিনি, সবটাই সুবিমলদা নিজে করেছে’। আর এটা
ঘটনা সুবিমলদার বইয়ের সর্বত্র একটা শব্দও সুবিমলদার অনুমতি ছাড়া ছাপা হতো না।
আর ঠিক সেই সময়ে এক বছরের এদিক ওদিক – একটা কাগজে আমার বন্ধু পার্থর
প্রশ্নে মলয়দা বলেন – ‘আমরাই তো প্রথম বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিয়ে
আসি’। তখন আমি বলেছিলাম (হেসে) তাহলে এক কাজ করুন, রাজা নির্বাচন করুন।
বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার রাজা কে (হাসি)? কোনো movement  একা হয় না
 অনেকে মিলে হয়। তাই হঠাৎ এদের মধ্যে এই একমেবাদ্বিতীয়ম হওয়ার এই চেষ্টা আমাকে
অবাক করেছিল। তাও তো মলয়দা এখনও লিটল ম্যাগাজিনে লিখছে আর সুবিমলদা তো
সরাসরি এক মাল্টি ন্যাশনাল পাবলিশার থেকে ইংরেজিতে বই করল। আমি সুবিমলদাকে
বলেছিলাম – ‘এটা কী করলেন? আপনি জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি তো? এটা নিয়ে
কিন্তু প্রশ্ন উঠবে এবং প্রজন্ম প্রশ্ন করবে’? আমি যখন বাংলাদেশ গেলাম, বাংলাদেশ
ফিল্ম মুভমেন্টের জনক মুহম্মদ খসরু আমাকে বলেন – ‘এটা কি সত্যি যে সুবিমলদা
এরকম জায়গা থেকে বই করলেন’? আমার কষ্ট হচ্ছিল, খারাপ লাগছিল, কিন্তু সত্যিটা
স্বীকার করতেই হলো। আমার মনে হয় এই ঘটনায় so called  ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ শব্দটার
কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা। তারপর থেকে আর ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ বলি না আমি।
বলি, আমরা স্বাধীন লেখক, মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছি, কারো কাছে মাথা নোয়াইনি
কখনও। কারও বাড়িতে বই দিয়ে এসে বলিনি – ‘দাদা, দুটো লাইন লিখে দেবেন’।
এভাবেই কাজ করে যাব।

আচ্ছা, কবিদের দশক ভেদ মানে...

-(থামিয়ে দিয়ে) এটা খুব হাস্যকর ব্যাপার। মানে ডাক্তার, উকিলের তো দশক ভেদ হয়
না। মানে ষাটের দশকের ডাক্তার, সত্তর দশকের উকিল। এটা হাস্যকর। এটা কিছু লোক
আলোচনার সুবিধার্থে করেছে। কিন্তু এই নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে
আমি মনে করি না। হয় লেখক, নয় লেখক নয়, ব্যাস।

তোমার প্রথম দিকের কবিতায় যে দীর্ঘ কবিতার প্রবণতা ছিল, এখন একেবারেই দেখি না। কেন?

-এটা কী বলব! অনেক সময় হাগতে গেলে টর্পেডোর মতো ন্যাড় পড়ে (হাসি) আর
অনেক সময় ছোটো ছোটো ন্যাড় পড়ে। তো এখন ছোটো ছোটো ন্যাড় পড়ছে। তো কী
করা যাবে। টর্পেডো বেরোলে টর্পেডো হবে (হাসি)।

বুদ্ধি, আবেগ, অভিজ্ঞতা – কবিতায় কোনটাকে কতটা জায়গা দাও?

-তিনটেই। বুদ্ধি – মানুষ তো, বুদ্ধি করেই বেঁচে থাকি। আর মানুষ তো, আবেগ থাকবেই, না হলে রোবট হতাম। আরেকটা কী বললি...অভিজ্ঞতা...
বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা তো হবেই। অভিজ্ঞতা এই বেঁচে থাকাটা লিখতে সাহায্য করে।
কয়েকটা শব্দ বা লাইনে অনেক কিছু বলা হয়ে যায়, বেশি বকতে হয় না।

গ্রাফিত্তির প্রথম দিকের কাগজ পড়ে জানতে পারি, তখন লিটল ম্যাগাজিন জায়গা পেত না বইমেলায়। আজ এত লিটল ম্যাগাজিন মেলা চারদিকে, বইমেলায় লোকে টেবিল খুঁজে এসে বই নিয়ে যায়। কীরকম লাগে? এত ম্যাগাজিন পাঠককে বিভ্রান্ত করবে না কি?

-এটা তো পজিটিভ। এত ম্যাগাজিন হয়েছে বলেই লিটল ম্যাগাজিন মেলাগুলো হচ্ছে। আর
পাঠক খুব সেয়ানা। সে জানে, কোনটা পড়বে, কোনটা ফেলবে।

এত বছর লেখার পর পাবলিশার পেলে। পরপর দুটো বই পাখিগুলো কোথায় একটা ঘুমোচ্ছে (খোয়াবনামা), আমাদের কোনো ঘোড়া নেই (বিউটিফুল বুলশিট) অন্য পাবলিশার করল। এত বছর লাগল, যেটা কমার্শিয়াল কাগজে লিখলে হত না। আফশোস হয় না?

-আফশোস কেন? কমার্শিয়াল কাগজের খ্যাঁকশিয়াল হইনি বলে? না আমার আফশোস নেই।
আমি সম্মানিত এরা আমার বই করেছেন। বাংলাদেশে ‘প্রতিশিল্প’ আমার বই করেছে।
অ্যামেরিকা থেকে আমার চারটে বই হয়েছে, আর একটার কাজ চলছে। কলকাতার অন্য
কেউ না করলে করবে না। আমার পয়সা থাকলে গ্রাফিত্তি থেকে হবে, না হলে হবে না।
কারণ আমি তো জেনেই নেমেছি এই রাস্তায়। তাহলে মনস্তাপ করব কেন? আমি তো
তাদের গোয়ালে ঢুকিনি – কেন ছাপবে তারা (হাসি) – সকলের সাথে গলা মিলিয়ে
হোক্কা হোয়া কেন করতে হবে আমায়?

একটা বই থেকে আরেকটা বইয়ের মাঝখানে কী কী ভাবনা চিন্তা রাখ? নতুন বই মানেই তো নতুন কিছু প্রেজেন্টেশন, কী কী পরিবর্তন চাও?

-আসলে আমি চিরকাল যেটা ভেবে এসেছি, লেখালিখির দু’তিন বছর পর পর একটা বই
করলে লেখাটা পালটায়। কারণ লেখাগুলো ছেপে বই হয়ে গেলেই, সেই ধরনের লেখার
প্রতি আর টান থাকে না। মনে হয় – ঠিক আছে এটা তো হয়ে গেছে, এবার অন্য কিছু
করি। এবং এটা ভেবে চিন্তে নয়। ভিতর থেকেই হয়। একটা flow  তো, ups and downs  থাকে।
একটা খুব ভালো বইয়ের পর ভীষণ খারাপ একটা বইও হতে পারে। তাই বই করে
ফেলো। তোকে আর অন্তত অনেককে এটা বলেছি আমি। এটাই তোমার শ্রেষ্ঠ বই হবে –
নোবেল পাবে এসব না ভেবে কাজটা কর।

২০১৩-এ ‘একা শহর’, ২০১৪-এ ‘পাখিগুলো কোথায় একটা ঘুমোচ্ছে’ আর ‘আমাদের কোনো ঘোড়া নেই’, একসাথে দুটো বই, দু’বছরে তিনটে বই – সচরাচর এরকম কাউকে করতে দেখি না। এরকম করার কারণ কী?

সময় নিয়ে কী হবে? ছ’মাস পরে বাঁচব কিনা তার ঠিক নেই...আমি ফিউচার নিয়ে ভাবি
না। আমার কাছে আজকের দিনটা হলো বেঁচে থাকা আর কালকের দিনটা বোধহয় বেঁচে
থাকা। আমি এভাবেই ভাবি। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুম যেতে পারব কিনা জানি না,
মরে পড়ে থাকতে পারি। এত অপেক্ষার সময় আমার নেই। লিখেছি, লেখাটা হয়েছে – বই
করে ফেলো। লেখা হয়নি তাহলে করব না। অপেক্ষা আমার ধাতে নেই।
আমার way of writing  এটাই।

বাংলা কবিতায় ইদানিং খুব দেখছি পোস্টমডার্ন কবিতা বা পুনরাধুনিক কবিতা বলার হুজুগ। একি শুধুই কবিতাকে ট্যাগমার্ক দেওয়ার চেষ্টা? কী মনে হয়?

এটা হলো একটা প্যাকেটে বাসি চানাচুর, আবার আর একটা প্যাকেটে মনোহর চানাচুর
বা হলদিরামের চানাচুর। চানাচুরই তো আলটিমেটলি। কোথাও একটু টক ছিল বেশি
করে – এই যা তফাৎ। কবিতাটা কবিতাই। ওসব তকমা মেরে কোনো লাভ নেই।
থিয়োরিগুলো জানলে সমাজকে বুঝতে হয়তো সুবিধে হয় কিন্তু তাতে করে লেখালিখিতে
কোনো লাভ হয় বলে আমার মনে হয় না। বরং পাঠক ভয় পাচ্ছে, সরে যাচ্ছে।
কমিউনিকেট করতে পারছে না বলেই। কবি ভাবলেন কতগুলো শব্দ শুধু আমি জানি,
আমি লিখব সেগুলো – আহা কী একটা নতুন শব্দ তৈরি করলাম – আমি মহান। আরে,
নতুন শব্দ যে বানালে, তাতে কী এসে গেল? সেই আবার বলি, কনটেন্ট না থাকলে
শুধু structure  দিয়ে হবেটা কী?

হাংরি আন্দোলন নিয়ে তোমার কী মত? অনেকেই বলে, এই আন্দোলনে কোনো কাজের কাজ হয়নি, slang  হয়েছে খালি। বাংলা সাহিত্য কি কোনোভাবে হাংরির দ্বারা উপকৃত হয়েছিল আসলেই?

অনেকই উপকার হয়েছে। হাংরি বললেই আমরা ভাবি slang  । আর যদি তাও হয়, খারাপ
কী? এটা লিখতে গিয়ে হাত কেঁপে আরও ১০০ বছর কেটে যেত। একটা মেয়েলি ভাষাকে
পুরুষ করার দিকে এগিয়ে দিয়েছে হাংরি। আমাদের ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ আছে, সবাই তাকে
তুলে রাখি। কেউ পড়ি না। রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন – ‘ভড়ভড় করে হাগতে দোষ নেই,
বললেই দোষ’? তাতে কিন্তু রামকৃষ্ণদেব খারাপ হননি (হাসি)। যেই হাংরিরা বা ফাল্গুনীর
মতো কবিরা বলল – ‘বোনের বুকের থেকে সরে যায় অস্বস্তিময় চোখ’...অমনি কথা উঠল
– ওরেঃ শালা! একী হলো রে? এই জন্য আবার বলি, আমার কাছে ন্যাড়ের মতোই
কবিতা। কবিতা নিয়ে পুজোপাঠে বসে গেলাম গঙ্গা জল ছিটিয়ে, এটার মানে কী? কবিতার ব্রাহ্মণ্যবাদ!!! আলাদা করে রাখা। কবিতা এলিটিস্টদের সম্পত্তি নাকি? আমি এমন এক ভাষায় লিখব যে তুমি ছাড়া কেউ বুঝবে না – একটা গোপন ভাষা তৈরি করা যেন। সাংঘাতিক ব্যাপার। সেই মায়ান পুরোহিতদের মতো। কন্ট্রোলের ভাষা।




কিন্তু কমলকুমার বাবুও তো সেটাই করেছিলেন তাই না? একটা আলাদা নতুন ভাষা তৈরির চেষ্টা?



আমি কিন্তু কন্ট্রোলের ভাষার কথা বলছি। কমলকুমারের ব্যাপারটা আলাদা। তিনি হলেন লেখকের লেখক। কমলকুমার ভালো ভাবে পড়লে সেটা বোঝা যাবে। অনেকে বলে তার ফ্রেঞ্চ সিন্ট্যাক্স, এই সেই, ওসব কিস্যু না। পুরোনো বাংলা ভাষাকে নতুন করে রিপ্রেজেন্ট করা। কিন্তু তার মধ্যে এসব দুনম্বরি representation  নেই। বোধ আছে। কমলকুমার পড়লে বোঝা যায় –বেদ, বেদান্ত, পুরাণ ভদ্রলোকের গুলে খাওয়া। এবং তিনি একজন ভারতীয় লেখক। সেটা তাঁর লেখায় খুব স্পষ্ট। তাঁর লেখা আমাকে শিক্ষা দেয়। তার মানে এই নয় যে আমি তাঁর মতো লিখব – লিখব না। কিছু কিছু বই থাকে না শিক্ষা দেওয়ার। কমল বাবুর বই হলো সেটাই। এই বই কাউকে শিক্ষিত করতে পারে।

কিন্তু এখন তো মনে হয় কমলকুমার বেঞ্চমার্ক হয়ে যাচ্ছেন। হয়তো পড়িনি, তাও বলছি পড়েছি। না হলে লোকে কী বলবে?

ধুর সে তো  name dropping , বাচ্চাবেলায় হয়। এককালে আমিও বলতাম, আহা জেমস জয়েস, অসাধারণ লেখক। জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’-এর শব্দ তৈরির ফাঁদ আমায় টানে না। পরে জেমস জয়েসের ছবি দেখেছি। দেখে মনে হয়েছে – ইস, এ ভদ্রলোকের নির্ঘাত পটি হয় না (হা হা করে হাসি)। ‘ডাব্লিনারস’ ছাড়া জয়েসের কিছুই এখন পড়তে পারি না। এখন থেকে বহুদিন আগে একটা গল্প অনুবাদ করেছিলাম অবশ্য। সেটা হারিয়ে ফেলেছি যথারীতি, সাম্প্রতিক উত্তরণ-এ ছাপা হয়েছিল। তা তিনি ছিলেন মহান লেখক, এখনও আছেন নিশ্চয়ই। কাফকার লেখা – সেতো খালি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দুঃস্বপ্নের গল্প। টানে না আমায় আর। কাফকাও তো মহান লেখক। পিটার অরলভস্কি ভালো বলেছিল –
‘আমার দেখা হয়েছিল কাফকার সাথে।
আমাকে দেখেই সে বাড়ি টপকে পগারপার’।

বব ডিলানও তো ট্রিপ নিয়ে তারপর লেখেন ‘ট্যারান্টুলা’ – দুঃস্বপ্ন, প্রতীকী এইসব...

ট্রিপ দু’রকমের হয় – গুড ট্রিপ আর ব্যাড ট্রিপ। ওর ব্যাড ট্রিপ হয়েছিল। সে তো স্টিভ রিচমন্ডও ‘ডেমনস’ লেখে ট্রিপ নিয়ে। একই ব্যাপার।

একটা সময় গ্রাফিত্তি, উত্তরপর্ব এই বিষ অর্জন একসাথে করেছ। আবার কবিতা ক্যাম্পাসেও ছিলে, এতগুলো কাগজ একসাথে কেন?

একসাথে নয়। আলাদা আলাদা। শুরু করেছিলাম ‘সমবেত আর্তনাদ’ দিয়ে। আমার আবার একটা ব্যাপার আছে। ক’দিন পর পর কাগজের নাম পালটাতে ভালো লাগে। তারপর হলো উত্তরপর্ব এই বিষ অর্জন – বিসর্জন ভেঙে করলাম বিষ অর্জন। তারপর ভাবলাম ধুর এসব করে লাভ নেই। একটা গ্রাফিত্তি করি। ব্যাস।

‘হোক কলরব’ সেই রাস্তায় নামা। সেদিন বৃষ্টিতে তুমি, আমি দু’জনেই হেঁটেছিলাম মিছিলে। ‘হোক কলরব’ একটা অদ্ভুত রংহীন প্রতিবাদ লেগেছিল। অথচ বাংলা সাহিত্যের বহু প্রতিবাদী নাম সেদিন উধাও ছিল। কী রকম অনুভূতি ছিল সেটা?

আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিল সেদিন মিছিলে হাঁটতে পেরে। পৃথিবীর যে কোনো বিপ্লব তরুণ ছাত্ররাই করে। এটা একটা শুরু মনে হচ্ছিল। নতুন কিছুর, নতুন হাওয়ার। আমরা পাশে ছিলাম যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের।

গ্রাফিত্তি নিয়ে কী ভাবছ – আগামী পরিকল্পনা?

কাগজটা আবার শুরু করেছি। অনেক কিছু বলার আছে। আপাতত পরপর তিনটে সংখ্যা আসছে। ডিসেম্বর ২০১৪, জানুয়ারি ২০১৫, ফেব্রুয়ারি ২০১৫। দেখা যাক।

কবিতায় ছন্দ ব্যবহার আজ কি আর আদৌ জরুরি, মানে সেই মাত্রাবৃত্ত, কলাবৃত্ত, সনেট লিখব – এরকম ভাবার আজ কি আর দরকার আছে?

এককালে লিখেছি আমিও ছন্দে। কিন্তু আলটিমেটলি আমার মনে হয়েছে, টের পেয়েছি যে প্রকৃতির একটা নিজস্ব ছন্দ আছে। এই যে কথা বলছি, কটা শব্দ এক নিঃশ্বাসে বলতে পারব, সেটা কিন্তু মাপা। আমি কখন নিঃশ্বাস নেব, কখন ছাড়ব সেটাও মাপা। এটাই ছন্দ আমার কাছে, নিঃশ্বাস নেওয়া আর ছাড়াটাই ছন্দ। লেখার সময়ও এই প্রক্রিয়াটা চলে– সেটা আমার ভিতরেই আছে, আলাদা করে আঙুল গোনায় আমি বিশ্বাসী নই আর। so called sonnet লিখব বলে বসলাম, পারলাম না। যদি ভেতর থেকে আসে হলো – এল না তো হলো না।

সম্প্রতি একটি কাগজে কবীর সুমন বলেছেন – বাংলা গানে মহীনের ঘোড়াগুলির কোনো অবদান নেই, আটটা-দশটা গান দিয়ে হয় না ইত্যাদি...

কে কবীর সুমন!!!

নতুন বই কি পাব?

বইমেলা ২০১৫-এ বত্রিশ পাতার নতুন চ্যাপ বুক ‘বত্রিশ পাতা’ (হাসি)


কথা বলেছেন অভিষেক চক্রবর্তী
১৮০ ডিগ্রি পত্রিকা-তে প্রকাশিত