Saturday, September 30, 2017

চার্লস বুকাওস্কি-কে ভালোবেসে, ঘেন্না করে

চার্লস বুকাওস্কিকে নিয়ে বই আছে অনেক কিন্তু  কোনোটাই লিন্ডা কিং-এর এ বইয়ের মতো নয়। এটা যেন আয়নার অন্য পাশ দিয়ে দেখা। ওদের পাঁচ বছরের প্রেমের ঝোড়ো জীবনের জীবন্ত দলিল। তাই অনেক সময়ই অপরিমার্জিত, কিছু না লুকোবার চেষ্টা করে বলে যাওয়া সেই আবেগের দিনগুলোর কথা, সেই গভীর প্রেম আর প্রেমহীনতার কথা, যা সরাসরি ধাক্কা মারে আমাদের হৃদয়ে কোথাও।


                                                             



প্রথম ভাগ


সে রাতটা ছিলো ১৯৭০-এর জুলাই মাসের দ্বিতীয় দিন। ‘দা ব্রিজ’-এর বাইরে আমি আমার মেরুন গাড়িতে পিঙ্ক ডট লাগাচ্ছিলাম। আঠা লাগানো এই পোলকা ডটগুলো যেন চিৎকার করে বলছিল দশ বছর বিয়ের পর আমার স্বাধীনতার কথা। আমি বাড়ি ফিরছিলাম বোল্ডার, উটায়। ৪ঠা জুলাইয়ের জন্য, রাস্তায় নেমে পড়তে মন উচাটন হয়ে উঠছিল। ওটা আমাদের ফ্যামিলির পরম্পরা। ওই দিন সবাই এক সাথে হই আমরা। ধৈর্য থাকছিল না কিন্তু চার্লস বুকাওস্কির লসঅ্যাঞ্জিলিসের এই কবিতা পাঠও মিস করতে চাইছিলাম না একটুও।
আমি অনেক আগে এসে গেছি। এই ‘দা ব্রিজ’ ছিলো একটা বইয়ের দোকান, ভাঙা সোফা আর চেয়ার আর কিছু পুরোন তোশক আর দু একটা ভেঙে পড়া টেবিলে ভর্তি। দেওয়ালগুলোয় উজ্জ্বল রঙে রাঙানো সব পেন্টিং। ফুল, পাখি, জন্তু জানোয়ার আর মানুষ। শীতের সময় আমি গিয়ে দেখেছি সেখানে পিটার দেওয়াল থেকে বেরনো একটা গ্যাসের পাইপের মুখে আগুন জ্বেলেছে যাতে ভেতরটা গরম থেকে। আর আমি সারাক্ষণ ভেবেছি কখন অঘটনটা ঘটবে, পুরো ঘরটা উড়ে যাবে আমাদের নিয়ে।
কদিন আগেই আমার দেখা হয়েছে সিলভার পাস্তেরনাকের সঙ্গে যার সঙ্গে ইদানীং আমি ডেটিং করছি ‘দা ব্রিজ’-এ। ও বেশ ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ। ওর সাইকোলজি আর ইকনমিক্সে ডিগ্রী আছে এখন ও পড়ছে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে।
এ রাতের শ্রোতারা দেখি সব বাওয়ালবাজ। হাতে ছ প্যাকের বিয়ার আর ওয়াইনের বোতল। কয়েক জোড়া নারীপুরুষ তো খোলাখুলি গাঁজা টানছে। আর তার মিস্টি গন্ধে ভরে যাচ্ছে ঘরটা। আমি কান পেতে শুনছি আশেপাশে কী  বলাবলি করছে লোকজন।
‘ওতো একেবারেই একটা পেঁচো মাতাল। জানিনা কীভাবে ও লেখে আদৌ...’
‘খানকির ছেলেটার কথাবার্তা খুব বিশ্রী’।                 
‘আরে আমি তো শুনেছি ওর আগের বৌকে ও হেভি পিটিয়েছে, যে ওর মেয়ের জন্ম দিয়েছিল। সেই মেয়েটাকে’।
বুকাওস্কি অনেক দেরিতে এলো, একটু যেন নার্ভাস। একটার পর একটা বিয়ার ঢক ঢক করে গিলছিলএকেকটা বোতল এমন ভাবে খুলছিল যেন ওটা প্রপ, ঠেকনো দেওয়ার জন্যতারপর শুরু করলো কবিতা পড়তে। কবিতাগুলো খুব ঠিকঠাক বাছাই করা, তবে বিভিন্ন বই থেকে।  কবিতাগুলো ছিলো মাটির কাছাকাছি, সোজাসাপ্টা, দুষ্টুমি আর মজায় ভরা। ও পড়া শেষ করল একটা গল্প দিয়ে। গল্পটার নাম ছিল ‘ছ ইঞ্চি’। এটা একটা মেয়ের গল্প যে তার পেমিককে ছ ইঞ্চি বানিয়ে দিয়েছিল। আর আরাম পেতে তাকে ব্যবহার করতো ডিলডোর মতো। আমার মনে হয়েছিল এটা বেশ অপমানজনক উৎকট পুং মানসিকতার দৃষ্টিতে একটা মেয়েকে দেখা কিন্তু লেখাটা ছিল মজার। ওর সাহসী কথাবার্তা আমাকে আকর্ষিত করেছিল।
কবিতা পাঠের পর আমি তার কাছে উঠে গিয়ে বললাম, ‘তুমি মেয়েদের খুব একটা পছন্দ করোনা, তাই না’?
‘একদম তা নয়। আমি ভালোবাসি মেয়েদের’।
ওকে ঘিরে ছিল সই শিকারির দল। ও ওর বিয়ার ধরা হাত উপরে তুলে চেঁচালো, ‘এসো মাতাল হই। পার্টিটা হবে আমার বাড়িতে’।
আমি ভেবেছিলাম চার্লস বুকাওস্কির সাথে ওই হবে আমার শেষ দেখা। লোকটা মাতাল, উৎকট পুং মানসিকতার সাথে আছে লোককে গালাগালি করার অভ্যেস, কিন্তু লোকটা তবুও আকর্ষণ-পূর্ণ। ও এত মজার আর সাহসী আর ও একজন লেখকও তো বটে।
বুকাওস্কির কবিতা পাঠের কয়েক সপ্তাহ পরে আমি ‘দা ব্রিজে’ গিয়ে থামলাম এক রাতে। এটা দেখতে কী চলছে সেখানে। মিউজিকের জ্যাম সেশান চলছিল। কিন্তু খুব খারাপ। আমি ছটফট করছিলাম। মনে হচ্ছিল ওই লোকটা যে বাঁশি বাজাচ্ছে থামবে না কোনোদিন। আমি পা টিপে টিপে চলে গেলাম বইয়ের দোকানে।
‘কোথাও কিছু ঘটছে?’ আমি পিটারকে জিজ্ঞাসা করি, ‘আজ রাতে ভালো লাগছে না এত চুপচাপ থাকতে’
পিটার ফোন ঘোরালো। ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আসছি আমরা’। ও আমার দিকে ফিরে বলল, ‘আমি তোমাকে চার্লস বুকাওস্কির কাছে নিয়ে যাব’।
‘ওরে বাবা, না’।
‘হ্যাঁ। আমি বলেছি আমরা আসছি’। পিটার জেদ ধরলো।
এমনিতেই বোর হচ্ছিলাম। দেখাই যাক...
আমি পিটারের সাথে যাব ঠিক করলাম কিন্তু পর মুহূর্তেই ভুলটা বুঝলাম যখন পিটার পাগলের মতো গাড়ি চালাতে শুরু করলো, ক্যাঁচ করে ব্রেক কষল একটা মদের দোকানের সামনে আর তখন গাড়িটা ঘন্টায় ৬০ মাইল বেগে চলছে।
‘ভেতরে ঢুকতে গেলে আমাদের বিয়ার নিয়ে যেতে হবে। ছ প্যাকের বিয়ার ছাড়া ও কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না’ও দৌড়ে মদের দোকানে ঢুকল আর ফিরে এলো দুটো ছ প্যাকের বিয়ার নিয়ে।
‘চলো ফিরে গিয়ে আমার গাড়িটা নিয়ে আসি’, আমি বললাম। ‘তাহলে যখন ইচ্ছে করবে আমি ফিরে যেতে পারবো’।
‘ঠিক আছে’। সারা রাস্তাটা গাড়ির চাকাগুলো ক্যাঁচক্যাঁচ করে চললো। আর সে ট্রাফিকের ফাঁকফোকর গলে ডান দিক বাঁ দিক করতে করতে ‘দা ব্রিজে’ পৌঁছল।
‘আমি এখনই আসছি’ বলে, গেল দোকানে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম সে তর্ক জুড়ে দিয়েছে গায়ক বনি হোয়াইটের সঙ্গে। বুঝলাম মেয়েটি তার প্রেমিকা। সে ফিরে এলো ক্যাশ বাক্স হাতে নিয়ে। আমি কি পাগলে যাচ্ছি। আমি পিটারকে চিনিওনা ঠিক করে।  চার্লস বুকাওস্কিকেও চিনি না আমি আর এখন বনি হোয়াইট ভাবছে তার প্রেমিককে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু আমি ওর পেছনে পেছনে গাড়ি চালিয়ে ট্রাফিকের মধ্যে দিয়ে পৌঁছলাম বুকাওস্কির বাড়ি। ডিলংপ্রি-তে।
দরজা আর জানালাগুলো বড় বড় আগাছায় ঢেকে আছে। বুকাওস্কিকে বেশ বয়স্ক লাগছে...খুব বুড়ো, মোটা...বেশ মোটা আর ফুলটু মাতাল।
‘এ হচ্ছে...’ পিটার আমার নাম জানত না।
‘মোরোনা’ আমি বুকাওস্কির দিকে হাত বাড়িয়ে ধরলাম।
‘মোরোনা’ ওরা দুজনে এক সঙ্গে বললো
‘তোমার আসল নামটা কী’? বুকাওস্কি জিজ্ঞাসা করলো।
‘ওটাই। আমার বাবা মা ওই নামটাই রেখেছে’।
‘ঠিক আছে মোরোনা, বোসো,  বোসো’, বলে আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন আমার চোখ, কান, আত্মা কিছুই নেই। পিটার হাত বাড়িয়ে বিয়ারগুলো দিতে শুরু করলো।
‘ভদ্রমহিলা একটু ছটফট করছিল’, জানালো পিটার। 
‘তো তুমি কবিতা লেখো’? বুকাওস্কি জিজ্ঞাসা করলো। পিটার আর বুকাওস্কি একবার চাওয়াচায়ি করলো একে অপরের দিকে।
হ্যাঁ লিখি। একটা লেখা মুখস্থ করেছি যদি ‘দা ব্রিজ’-এর খোলা কবিতা পাঠের আসরে পড়তে পারি, তাই’।
‘মুখস্থ করেছ’? বুকাওস্কি আরেকবার তাকায় পিটারের দিকে।
আমার বেশ কয়েকটা বিয়ার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।
‘শোনাবো’?
ও তাকাল আমার দিকে –
আমি পড়তে শুরু করলাম –

কীভাবে দেখব তাতেই সবটা নির্ভর করে

আমি এই গল্পটা বলছি যাতে সবাই বোঝে
পাগলে যাওয়াটা কীভাবে একটা গুণও হতে পারে
কেউ কেউ বলে ওটা একটা কালো সাপের গর্ত
কিন্তু আমি বলি, কীভাবে দেখব তাতেই সবটা নির্ভর করে।

পিটার লাফিয়ে আমার সামনে এসে চেঁচাতে থাকে, ‘চার্লস বুকাওস্কির সামনে এসব নয়’।
‘কেন নয়...? আমার কবিতা শুনলে ও আমাকে ঠিক টের পাবে’। আমি লাফিয়ে ওর পুরনো কফি টেবিলের উপর উঠে আমার কবিতার পাগলি মেয়েটির চরিত্রের অভিনয় শুরু করলাম।

এই শব্দগুলো সেই মেয়েটির
আর এখন আমার থাকতে ভালো লাগছে এই বুকওয়ালা পেনের ভেতর
এটা খুব ভালো জায়গা হতো যদি না ডাক্তারটা থাকত
যে শুধু এসে তোমায় ইলেকট্রিক শক দিতে চায়

বুকাওস্কি হাত বাড়িয়ে ওর সিম্ফনি মিউজিকটা তেড়ে চালিয়ে দিলো। আমি আমার অভিনয় চালিয়ে গেলাম। পিটার আমায় জড়িয়ে ধরে আমার মুখ চাপা দিতে চেষ্টা করছিল, আমার বুক টিপছিল আর চিৎকার করে খিস্তি করছিল। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অভিনয় চালিয়ে গেলাম এই হট্টগোলের ভেতর।

আমি এখন বাইরে কিন্তু সবাই ঠিকই চেনে আমায়
কেউ কেউ লুকোবে এটা ভেবে যে এ বড় লজ্জার
কিন্তু আমি, আমি শুধু বলি ধোর বাঁড়াটা
কীভাবে দেখব তাতেই সবটা নির্ভর করে।

পিটার লাফাতে শুরু করলো। ‘চলো নাচি। চলো লাগাই’। পিটার চেপে ধরেছে আমায়। বুকাওস্কি আমার পায়ে হাত বুলোচ্ছে। যাক কবিতাটা পড়ে শেষ করা গেল।

ফোনটা বেজে উঠল তখনই। পিটারের বান্ধবী তেড়ে চেল্লাচ্ছে। পিটার ফোনটা আমাদের দিকে ঘুরিয়ে ধরলো যাতে আমারা শুনতে পাই।
‘আমাকে যেতে হবে এখন পয়সাটা ফেরত নিয়ে’, পিটার রেখে দিলো ফোনটা। ‘আগে আমাকে চুমু খাও’। ও জবরদস্তি একটা চুমু খেলো আমায় আর আমি ঠেলে সরালাম ওকে। ‘এসো আমরা দুজনে মিলে ওকে লাগাই’, বুকাওস্কিকে ও বললো
‘আমিও যাবো’, আমি দ্রুত বললাম।
‘না তুমি যাবে না। তুমি হ্যাঙ্কের সাথে থাকবে এখানে’। পিটার আমাকে ধাক্কা দিয়ে আমাকে সোফার উপর বুকাওস্কির কোলে ঠেলে দিলো। আর দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ফের ফিরে এসে দরজা খুলে বুকাওস্কিকে বললো, ‘আর বোলো না যে আমি তোমাকে কখনো কিছু দিই না’।

হঠাৎ সবকিছু বড় চুপ মেরে গেল। আমি তাকালাম বুকাওস্কির দিকে। সেও তাকাল আমার দিকে। আর আমি জানতাম ওর সাথে আমার কিছু হওয়ার নয়। সেও জানতো আমার সাথে ওর কিছু হওয়ার নয়। আমাদের নাকে নাক ঠেকে আছে প্রায়। আমি একটা ছোট্টো চুমু দিলাম...সত্যিকারের চুমু নয়, জাস্ট একটূ ছোঁয়া। ও কিছুই চেষ্টা করছে না। হুমমম...আরো দু একটা ছোঁয়া, খুব আস্তে।

‘তুমি আমাকে খেপাচ্ছ’।
‘হ্যাঁ, খেপাচ্ছি তো’।

ও আমার দিকে এগিয়ে এলো কিন্তু আমি সরে গেলাম। ‘এবার ছোটো মিস মাফেটকে যেতে হবে’।
‘দাঁড়াও। আরেকটু থাকো’, ও বললো।
আমি সরে এসে উঠে দাঁড়ালাম। সেও উঠে দাঁড়ালো। আমাদের ঠোঁট আরেকবার ছুঁয়ে গেল। আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম।