Thursday, March 21, 2019

স্টকহোমের শেষদিন






বুকাওস্কি প্রথম কবে পড়েছিলাম মনে নেই আর। খুব সম্ভবত হাংরিদের প্রকাশিত কোনো কাগজে ইংরেজিতেই একটা কবিতা পড়ি। এবং আমাদের প্রকাশিত কাগজপত্রে সেটা আবার ছাপি। লোকজন আওয়াজ টাওয়াজ দিয়েছিল মনে আছে। চিরকালই অর্ধশিক্ষিত এই সবজান্তা গামছাওয়ালারা গোঁফ ফুলিয়ে যা করে আরকি। বয়স কম ছিল বলে চুপ করে গেছিলাম জবাব দিতে পারিনি। সে যুগে ইন্টারনেটও তো ছিল না। জাস্ট একটা কবিতা পড়ে তাকে নিয়ে লড়ে যাওয়ার ক্ষমতাও। অনেক পরে কোলকাতার ফুটপাতে বুকাওস্কির উপন্যাস Post Office পাই খুব সম্ভব, সেটা ২০০৩ সাল। তখন পড়ে মজা পাইনি তেমন। যেমন হার্মান হেসের সির্দ্ধার্থ পড়েও। তখনও সার্ত্রে, জয়েস, কাফকার ভুলভুলাইয়াতে ফেঁসে আছি আমি। অলংকার আর অহংকার আর ইন্টেলেকচুয়াল ত্যাঁদড়ামোর আলো অসম্ভব সঠিক বলে মনে হচ্ছে। তখনও a drop of pure light বস্তুটা বুঝলেও বোধগম্য হয়নি। ওর জন্য Wise হয়ে উঠতে হয়। Shaman হতে হয়। বুদ্ধির ধার দিয়ে ওকে ছোঁয়া যায় না। আমরা ভারতীয়রা অন্তত সাটল স্বাদের কদর বুঝি না। আমাদের বেড়ে ওঠাও তো বেসিক কালার্স-এর মধ্যেই। তীব্র ঝাল টক মিষ্টিতে অভ্যস্ত আমরা। বৌধ্য ধর্মের শূন্যবাদ তাই ভারতে জন্মেও ভারতে ঠেক পায় না। জাপান তাকে সাদরে গ্রহণ করে। আমরা আর কী করে হাইকু বুঝবো। আমাদের ভালো লাগবে জয়েসের ইউলিসিস। কারণ সেটা বোঝা যায় না। শব্দের সার্কাস আর ফর্ম নিয়েই আমরা মজে আছি।
এখানে একটা মজার গল্প বলি। আমার চোখ যেদিন প্রথম খোলে তার গল্প। একবার এক জার্মান ভদ্রমহিলার বাড়িতে খেতে গেছি। এক প্লেট স্প্যাগেতি চলে এলো। এক চামচ মুখে দিয়ে মনে হলো এ আবার কী? এতো স্রেফ সেদ্ধ। ভুরুটুরু কুঁচকে দ্বিতীয় চামচ খাওয়ার পর টের পেলাম সেই পাতার গন্ধ। খুব সূক্ষ্ম। আমাদের চড়া দাগের জিভে যা চট করে ধরা দেয় না। দেবে না। সাহিত্যের পাঠও ঠিক তাই। সেরিনিটির মজা মোৎজার্টের মিউজিকের মতো যে পেলো সে বর্তে গেল। যে পেলো না তার জন্য করুণা ছাড়া আর কী থকতে পারে।
এত বছর পর বুকাওস্কিকে আবার ইন্টারনেটে আবিষ্কার করলাম এই তো সেদিন। হুড় হুড় করে পড়ে ফেললাম Ham on Rye, Hollywood, Women, Factotum এবং আরেকবার সেই Post Office-এর পুরোনো বইটা। নেট থেকে নামানো তাঁর বেশ কিছু কবিতাও। মানে একটা বুকাওস্কি জ্বর নিয়েই স্টকহোম পৌঁছেছিলাম।
১৯এ নভেম্বর ২০১০ সন্ধ্যায় সুইডিশ কবি হেনরি দিনানদারের বাড়িতে আমন্ত্রণ। বোয়েল আমাকে হোটেল থেকে পাঁচটা নাগাদ তুলে নিয়ে যাবে। সেরকম কথা আছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি একটা ছোট্ট বোতল নিয়ে বাথরুমে গেলাম। হেগে কাগজ দিয়ে মোছার অভ্যাস আমার কোনোদিনই নেই। কেমন যেন গা ঘিন ঘিন করে। কোনো বাথরুমেই মগ বলে কোনো বস্তু নেই তাই বেসিন থেকে জল ভরে বোতল দিয়ে কাজ সারতে হতো আমায়। তারপর একটা চওড়া টিসু নিয়ে পেছন মোছা। এই চওড়া টিসুটার নাম দিয়েছিলাম আঁস ওয়াইপ, জানি না এটার সত্যিই তাই নাম ছিল কিনা।
ঘর থেকে বেরিয়েই ঝট করে স্লট মেশিনে ক্রোণা ঢুকিয়ে এক কাপ কড়া গরম কালো কফি নিয়ে নেটে বসলাম। এথেন্সের জন্য কত লাগবে এখান থেকে তাই দেখতে। এই ঠাণ্ডা আর সহ্য হচ্ছিল না। মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়ার পর একবার ফেসবুকে ঢুকলাম। দেখি হেনরি আমার কবিতা পাঠের ফটোগুলো আপলোড করেছে। আর সারা পৃথিবী থেকে আসা কমেন্টগুলো পড়তে মজাই পাচ্ছিলাম।
সকালবেলা বেরিয়ে পড়লাম কোনো ট্রাভেল অফিস যদি পাওয়া যায় তাহলে প্লেনের টিকিটটা কাটবো এথেন্সের জন্য। ইয়োরোপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। এথেন্সে ঠাণ্ডাটাও অনেক কম। কোলকাতার ঠাণ্ডার মতো। কিছুটা ভারতীয় টাকা ছিল কাছে। একটা Forex Exchange খুঁজে সেটাকে প্রথমিক ভাবে ভাঙ্গিয়ে ইউরো করলাম কিন্তু বেশ খানিক্ষণ হাঁটাহাটি করেও কোনো ট্রাভেল এজেন্টের অফিস চোখে পড়ল না। বেরোবার সময় কেন যে রিসেপশনে জিজ্ঞেস করিনি কে জানে।
সারাক্ষণই মানুষের কেন যে খিদে পায়! রাজাদের হাঁটাহাঁটির জন্য একটা বাগান যা এখন জনতার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে যার এক কোণে বাচ্চাদের স্কেটিং করার জন্য একটা স্কেটিং রিং। কিছুক্ষণ তাদের হুল্লোড় হৈ হৈ দেখতে দেখতে এগোলাম সামনের দিকে। বাচ্চাদের এই হুল্লোড় চিৎকার পৃথিবীর সব জায়গায় একই, সে বোসপুকুরই হোক বা এই সুইডেন। রাস্তার উপর একটা রোলের স্টল দেখলাম। খাবার দাবার বেশ সস্তা কিন্তু এই দশটা এগারোটার সকালেও সেটা জাস্ট বন্ধ। অতএব আরেক ঢোক জল আর হাঁটা, আর ছবি তোলা। রাস্তায় এদিক ওদিক দাড়িয়ে লোকে সিগ্রেট ফুঁকছে। ছেলেদের তুলনায় মেয়ে স্মোকার অনেক বেশি। আরেক ঢোক জল। তারপর রাস্তা পেরিয়ে আরেকটা নতুন গলিতে ঢুকে পড়া। মনে মনে অবশ্য ভয় করছিল হারিয়ে না যাই। কোলকাতাতেই তো কতবার এই হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রোড সেন্স আমার চিরকালই খুব খারাপ। তাই খুব বাড়াবাড়ি না করে আরেকটা চক্কর মেরে উঠতে উঠতে হঠাৎ আবার অন্ধকার করে এলো। আর সঙ্গে সেই তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়া। সোজা হোটেলের দিকে পা চালানো ছাড়া আর গতি নেই বুঝলাম। যাকগে সুটকেশ গোছাতে বেশ ভালোই লাগে আমার। আবার আরেকটা বেরিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হতে।
চাবি কার্ড দিয়ে গেটের পর গেট পেরিয়ে আবার আমার ঘরে।



I have died too many times
believing and waiting, waiting
in a room
staring at a cracked ceiling
waiting for the phone, a letter, a knock, a sound…
going wild inside 
বুকাওস্কির এই কয়েকটা লাইন মাথায় পাক খাচ্ছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি হঠাৎ ফোনে ঘুম ভাঙল।
-‘আমি পৌঁছচ্ছি তুমি বেরিয়ে এসো। ওই একই জায়গায় দেখা হবে আমাদের’। বোয়েল। তাড়াতাড়ি উঠে দ্রুত জামাকাপড়, জ্যাকেট, গ্রাফিত্তির কালো ঝোলা তুলে আমি বেরিয়ে পড়লাম। গেটের পর গেট পেরোতে পেরোতে মাথা ঢাকা টুপিটা টেনে পরতে পরতে। একমুখ হাসি নিয়ে দেখি বোয়েল দাড়িয়ে।
‘তুমি তো ওল্ড টাউন দেখনি। যাবে নাকি?’
‘আলবাত’।
‘চলো। হাঁটতে অসুবিধে নেই তো?’
‘একদম না।‘
শহরের মধ্যে আরেকটা শহর এই ওল্ড টাউন। তার এদিক ওদিক চলে যাওয়া পাথুরে রাস্তারা আর তার উপর অদ্ভুত মায়াময় এক হলুদ আলোর রূপকথা। একটা সন্ধ্যের বরাত আমার। ক্যামেরা চালিয়েও সুবিধে হচ্ছিল না। আলো বড় কম। চোখ দেখতে পেলেও ক্যামেরার চোখে তাকে বন্দী করার চেষ্টা বৃথা যাচ্ছিল। ফ্ল্যাশে তুলে পুরো রূপকথাটা খবরের কাগজের ফ্ল্যাট নিউজ করতে চাইছিলাম না আরকি।
একটা ছোট্ট দোকান দেখে দাড়িয়ে পড়লাম। দোকানের বাইরের ফুটপাতে নানান জিনিসের সাথে সস্তায় কিছু পিকাচার পোস্টকার্ড সাজানো আছে। কয়েকটা পিকচার পোস্টকার্ড বাছলাম কিনব বলে। তারপর ভেতরে গিয়ে একটা ছোট্ট টেবিলটপ ক্যালেন্ডারও পছন্দ হলো, বোয়েল কিছুতেই আমাকে দাম মেটাতে দিলো না।
‘আমি এটা তোমায় উপহার দিচ্ছি’।
ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট বাজার। ঘুরতে ঘুরতে দুজন বয়স্ক ভদ্রমহিলার ছোট্ট দোকানে এসে থামলাম। রকমারী সুইডিশ মারমালেড। কমলালেবুর আচার। এটা ওটা চাখতে চাখতে ওয়াইন দিয়ে তৈরি একটা আচার পছন্দ হলো আমাদের। দুটো বোতল কিনলাম। একটা বোয়েলের জন্য উপহার আর অন্যটা বাড়ির জন্য। যা অবশ্য বাড়ি অবধি আর আসেনি। এথেন্সের এয়ারপোর্টে হ্যান্ড লাগেজে ওটা রাখার অপরাধে সেটা আমাকে বহু অনুরোধের পরও ট্র্যাশ করতে হয়েছিল
বোয়েল  একদম নিরামিষাশী আর আমি তো সর্বভূক প্রায়। তাই আবারও একটা মাংসের দোকানে দাড়ালাম। নানারকম মাংস দেখতে দেখতে বিশাল বিশাল সসেজের মতো অথচ টকটকে লাল মাংস দেখে থমকালাম।
‘ওই বস্তুটা কী বোয়েল?’
‘ওটা? ওটা একটা স্পেশাল ডেলিকেসি। মাংসের মধ্যে রক্ত মেশানো’।
পেটটা কেমন গুলিয়ে উঠল। আর এক মুহূর্ত দাড়ালে আমার বমি হয়ে যাবে। আমি হাঁটা দিলাম।
‘কী হলো, কিনবে না?’
‘না থাক বোয়েল। থাক বরং চলো একটু কফি খাই’।
কফি খেয়ে ওখান থেকে হেঁটে কাছেই একটা পাতাল রেল স্টেশন। এই প্রথম দেখলাম সামনে টুপি খুলে মাটিতে রেখে একটা ছেলে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। পরে শুনেছি সুইডেনের দুঃখীদের জায়গা আন্ডারগ্রাউন্ডে। শহরের উপর এদের দেখতে পাওয়া যায় না। আমি টিকিট কাটতে গেলে বোয়েল বারণ করলো। আমাকে নাকি টিকিট দেওয়া হবে না। তবে কি সুইডিশ পাতাল রেল শুধুমাত্র সুইডিশদের জন্য? কোলকাতার মতোই চাপাচাপি ভিড় নিয়েই এই টিউব রেল ভ্রমণ। নেমে বাড়ি খোঁজার পালা এবার। বোয়েলও এই প্রথম হেনরির বাড়ি যাচ্ছে। দুজনে এক শহরের বাসিন্দা হয়েও ওদের আলাপ আমার সূত্র ধরেই। ভাবা যায়।
বেল বাজানো হলো। ওপর থেকে সুইচ টিপে নীচের দরজা খুলে দিলো হেনরি। আমরা লিফটে চেপে পৌঁছলাম হেনরির ফ্ল্যাটে।
ঢোকার মুখে একটা এক চিলতে ঘরে জ্যাকেট জুতো খুলে রেখে লম্বা ড্রইং রুমটায় ঢুকলাম। একদিকে কামিনী প্রেসের যুদ্ধ ক্ষেত্র। কাটিং মেশিন। কাটা কাগজ। কিছু বই মলাটহীন। কিছু তৈরি একদম। দেওয়াল জোড়া বইয়ের র‍্যাক, বইয়ের আলমারি আর পেইনটিং, ফোটোগ্রাফ, পোস্টার। বই দেখলেই চিরকালই ভেতরটা কেমন গুর গুর করে ওঠে আমার। একটা বন্ধ আলমারির কাঁচের এপার থেকে বই দেখছি, দেখি হেনরি এগিয়ে আসছে গুটি গুটি।
‘এটা বুকাওস্কির আলমারি। ওর সমস্ত বই এখানে আছে। সব। বুকাওস্কি আমার প্রিয় লেখক’। 
যার বই পাওয়ার জন্য আমি বছরের পর বছর হাপিত্যেস করে থেকেছি তার সব বই এই আলমারিটার ভেতর। গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছিল। ভালো লাগছিল যেমন তেমন একটা যন্ত্রণাও হচ্ছিল ভেতর ভেতর। ভাবছিলাম ইয়োরোপে থাকার সুবিধের কথা। জীবনে ক্রেডিট কার্ড না থাকায় আমাজন থেকে বইও কোনোদিন আনাতে পারিনি আমি। (২০১০-এ তাই ছিল)। এই প্রিভিলেজ ওদের শুধু। আমার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই কোনো। আমার লেখক বন্ধু শাশ্বত মাঝে মাঝে বই আনাত আমাজন থেকে। শুনেছি বইয়ের দাম প্রায় দুগুণ পড়ে যায় পাঠানোর খরচ জুড়লে। কী অসহ্য অবস্থায় আমরা আছি। এর সাথে তো আনন্দবাজারের বদামীও জুড়েছে। পুরো সাউথ এশিয়ায় যে পেঙ্গুইন ইংরেজি বই ডিস্ট্রিবিউট করে তার প্রায় অর্ধেকের উপর শেয়ার এরা কিনে নিয়েছে। এখন আমরা কী ইংরেজি বই পড়বো তাও এরা ঠিক করে দেয়।
হেনরি আর বোয়েল কেউই মদ খায় না। কিন্তু আমার জন্য হোয়াইট ওয়াইনের বোতল খোলা হলো। আর আমাকে সঙ্গ দিতে ওরা দুজনে এক বোতল স্পার্কলিং ওয়াটার নিয়ে বসল। সোডা ওয়াটারের আরেকটা ভার্সান। চলল তুমুল আড্ডা। অনেকক্ষণ ধরেই হেনরি উশখুশ করছিল কিন্তু কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। হঠাৎ শিশুর মতো মুখ নিচু করে বলে উঠল –‘তোমরা আমার টি শার্টের লেখাটা দেখেছ’? এতক্ষণ সত্যিই খেয়াল করিনি লেখাটা। দেখি কালো টি শার্টের বুকের কাছে ছোটো ছোটো অক্ষরে সাদা দিয়ে লেখা – I am not working.
হেনরির এখনকার সব বই-ই আমার কাছে আছে। কিন্তু ওর প্রথম দিকের  Bottle of Smoke Press 2005-এ প্রকাশিত Weeks Like This আমার কাছে ছিল না। অতয়েব বইটা সই করে আমাকে দিলো হেনরি। সঙ্গে Chiron review-এর ৭৬ নং সংখ্যা। যেখানে হেনরির একটা বড় সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। আর বোয়েল দিলো তার কবিতার বই Karlek Som Fobi (Love as Fobia)। আর পোস্টস্ক্রিপটামের দুটো সংখ্যা। একটা James Laughlin সংখ্যা আর অন্যটা ওদের কবিতা উৎসবের কবিদের কবিতা নিয়ে একটা সংখ্যা। আর আমাদের গ্রাফিত্তি কোলকাতা ব্রডসাইডে অনুপ্রাণিত হয়ে বোয়েলরাও একটা ব্রডসাইড বার করেছে সুইডেন থেকে। চিনের কবি Mindy Zhang-এর তিনটে কবিতার সুইডিশ অনুবাদের একটা ব্রডসাইড। আর একটা হ্যান্ডমেড কাগজের সুন্দর খাতা। যেটা দিয়ে বোয়েল বলল –This is a special gift for you. Fill this up with your poems and return it to me.
আমি জাস্ট কোন জবাব দিতে পারিনি। মুখ নিচু করে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। আমি কি এতটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?    

  

   


Wednesday, January 9, 2019

আরো খানিকটা স্টকহোম






আজ হেনরির বাড়িতে নিমন্ত্রণ। সন্ধ্যেবেলা বোয়েল আসবে আমায় নিতে। বেরিয়ে পড়লাম আরেকবার। হোটেল থেকে কিছুটা এগিয়ে গাছ ঘেরা একটা বাগান আছে। আগে রাজরাজড়ার ছিল। এখন ওটা সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।




 সকাল থেকেই অন্ধকার হয়ে আছে চারদিক। কাল যদি এথেন্স যেতে হয় কিছুটা ইউরো হাতে থাকা উচিৎ। সুইডিশ ক্রোনা আবার এথেন্সে চলবে না। বাগানের একটা পাশে বাচ্চাদের আইসস্কেটিং রিং আছে। বাচ্চাদের হুটোপুটি চিৎকারে থেমে দাঁড়িয়ে দেখলাম। আশেপাশে কয়েকটা খাবারের স্টল আর কফি ঘর নজরে পড়ল কিন্তু সব বন্ধ। এক কাপ কফি খোয়ার জন্য প্রাণটা ছুকপুক করছিল কিন্তু উপায় নেই। বড় দোকানগুলোতে ঢুকতে ভরসা হয় না। কত দাম নেবে কে জানে! আরো খানিকটা এগিয়ে বাঁদিকে দেখি একটি ছেলে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুকফুক করে সিগ্রেট ফুঁকছে। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে তার পিছনে একটা বিরাট শপিং মলের ভিতরে চলে যেতে বলল। পরে বুঝলাম সে আসলে এই মলেই কাজ করে। খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরে একটা কফি ঘরে কফি খাওয়া গেল। প্রাণ শান্ত হলো। এবার ফিরে হোটেলে বোয়েলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।



হেনরির স্টাডিটা লম্বাটে। প্রায় পুরো ঘরটা জুড়েই দেওয়ালে লাগানো একটা এল শেপের টেবিল। যার একদিকে ওর কম্পিউটার আর প্রিন্টার আর অন্যান্য টেবিলে লেখালিখির খাতা কলম বই ছড়ানো। হেনরি জানে ওর ভেতর আরেকটা হেনরি আছেযার ও নাম রেখেছে মিস্টার ব্লু। সেই হেনরি পেইন্টার। প্রচুর ওয়াটার কালারের কাজ, প্রিন্ট-এর কাজ সে করে। সারা ঘরময় ছড়িয়ে আছে শেষ হওয়া আর না হওয়া কাজগুলো। প্রধানত আমেরিকার নানান লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে ছড়িয়ে আছে এইসন পেইন্টিং, স্কেচ। এর ভেতর দুটো অসাধারণ কাগজ তো আমার সংগ্রহেই আছে The Vertin Press-এর The Cliffs Soundings এবং Aggressive Behaviour Anthology 2 . এই লেখাটা যখন লিখছি তখনই হুইড্রা থেকে পাঠানো হেনরির নতুন কবিতার বইটা হাতে এলো। Lummox Press প্রকাশিত The Accidental Navigator, যেখানে আফটার ওয়ার্ডে Gerald Locklin তাকে আমেরিকার কবি Edward Field, Charles Bukowski, Ron Koertge, Billy Collins-এর পাশে স্থান দিয়েছেন। যদিও হেনরি থাকে সুইডেনে আর মাঝে মাঝে নিজের বাড়ি হুইড্রায়। আর তার হুইড্রার বাগানের অলিভ নিয়ে তার গর্বের শেষ নেইপরের বার হেনরি, এক বোতল অলিভ আমার কোলকাতার বন্ধুদের জন্য দিয়ো।
আমি এথেন্স যাব অথচ এখনো টিকিট কাটা হয়নি শুনে হেনরি কম্পিউটার নিয়ে বসে গেল অনলাইনে টিকীট কাটতে। কিছুক্ষণ পর কাগজে প্রিন্ট আউট বেরোলো আমার ই-টিকিটের। ক্রোনা আর ইউরো মিলিয়ে আমি তার দাম মেটালাম। খেয়ালই ছিল না সুইডেনে ইউরো চলে না। পরের দিন ভোর পাঁচটায় আমার হোটেল থেকে যে ট্যাক্সি আমায় তুলবে তার ব্যবস্থা হয়ে গেল হেনরির বাড়িতে বসেই।
হেনরি মিনি বুক বের করে তার বাড়িতে বসেই। প্রকাশনার নাম কামিনী প্রেস।
-আচ্ছা কামিনী মানে কী? আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল হেনরি।
-কামিনী মানে নারী যাকে আমরা চাই।
-তাহলে তো ঠিকই আছে।
যে লিভিং রুমটায় বসে আমাওরা ওয়াইন খাচ্ছিলাম তার এক পাশে কামিনী প্রেসের ওয়ার্কশপ। কাটিং টেবিলে জড়ো করা আছে কবিতার নতুন মিনি বুকগুলো। যা হেনরি নিজেই কাটাকাটি করে তৈরি করে।

-তুমি আমার হুইড্রার বাড়ির চাবিটা নিয়ে যাও। এথেন্স থেকে বোটে কয়েক ঘন্টার পথ এই হুইড্রা দ্বীপ।
-না হেনরি আমি একা গিয়ে ওখানে কী করব? পরে যাব কখনো যখন তুমি থাকবে। আর তুমুল কবিতাপাঠ আর আড্ডা হবে তখন।
-ইয়ানিসের কিছু খবর পেলে?
-না ইয়ানিসের কোনো খোঁজ নেই। সবে বিয়ে করেছে এখন। জাস্ট ডুব মেরেছে। এখন ওর হদিস পাওয়া মুস্কিল। আর তা ছাড়া আমার আরো কিছু বন্ধুবান্ধব আছে এথেন্সে খুব অসুবিধে হবে না। কোলকাতায় বসেই প্লাকায় একটা ইউথ হস্টেল বুক করেছিলাম তাই বুকে একটা ভরসা তো ছিলই। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই থাকলে বাকিটা লড়ে নেওয়া যাবে।
পিৎজা খেয়ে রাতের খাওয়ার সেরে বেরিয়ে পড়লাম আমি আর বোয়েল। রাস্তায় এক বোতল ফ্রুট জুস আর একটা স্যান্ডউইচ কিনে নিলাম। অত সকালে কী খাবার জুটবে কে জানে। মনে পড়ছিল হেনরি কতগুলো বই আমাকে সই করে দিতে দিতে বলছিল – I am not working. পরে টের পেলাম তার টিসার্টে ওই কথাগুলোই লেখা ছিল।
বাকি পথটা ট্যাক্সিতে বসে কথা বলতে বলতে কখন পথটাই ফুরিয়ে গেল। বিদায় বলতে কোথায় যে কষ্ট হয়। তবু বিদায় বোয়েল আবার কখনো কোথাও নিশ্চয়ই দেখা হবে আমাদের ডিয়ার। বিদায়।
হোটেলের ঘরে ফিরে প্রায় গোছানো সুটকেশটাতে ফিনিশিং টাচ দিয়ে নিলাম। হ্যান্ড লাগেজে ক্যামেরা ইত্যাদি জামার মধ্যে সেট করে নিলাম যাতে ধাক্কা লেগে ভেঙে না যায়। এরপর সোজা বিছানায়। পেটে তখনো টলটল করছে হোয়াইট ওয়াইন। হেনরি বোয়েল কেউই মদ ছোঁয় না আমার সঙ্গে সঙ্গ দিতে তারা খেল স্পার্কলিং ওয়াটার। সোডা মেশানো এক ধরণের জল যা আমার একটুও ভালো না লাগলেও ইয়োরোপিয়ানদের খুব প্রিয়।





রাত দুপুরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘরের পোর্টহোল দিয়ে বাইরের অন্ধকার উঁকি মারছে। মোবাইলটায় সময় দেখতে গিয়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না কটা বাজে। একটা চাপা টেনশন কাজ করছিল। নাহ উঠে পড়া যাক। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ধরাচূড়া পরে জাহাজের ডেকে একটা কাচ ঢাকা ঘরে ব্যাগপত্তর নিয়ে বসলাম। বাইরে ঝর ঝর করে বরফ পড়ছেএকটা মরা হলুদ আলোর ভেতর। এভাবে বরফ পড়তে আগে কখনো দেখিনি। ক্যামেরাটা বার করে কয়েকটা ছবি তুললাম জাহাজটার। কেউ কোথাও নেই। ফ্রুটজুস আর স্যান্ডউইচের গতি করতে করতে ভাবছিলাম কীভাবে কত দ্রুত না ভিজে রিসেপশন অবধি যাওয়া যায়। খাওয়া শেষ করে ‘বলো বীর’ আর ‘জয় মা’ একসাথে বলতে বলতে গন্ধমাদন সুটকেশ আর নিজেকে সামলানোর সার্কাস দেখাতে দেখাতে অবশেষে রিসেপশনে। নিজেকে কেমন একটা তেঞ্জিং তেঞ্জিং মনে হচ্ছে।
আমার মোবাইলটার ভারতীয় সময় আর ইয়োরোপের সময়ের তালগোল পাকানো ঘেঁটে যাওয়া ব্যবস্থায় আমি রিসেপশনে রাত তিনটের সময় এসে উপস্থিত। জমা দিয়ে দিয়েছি আমার চাবি-কার্ড। এরপর একটা লম্বা অপেক্ষা ছাড়া উপায় থাকে না আর। মাঝে মাঝে ইউরো স্লট মেশিনে ঢুকিয়ে কফি খাওয়া ছাড়া। বাইরে ঘন হলুদ রাত্রি জুড়ে ছেঁড়া ছেঁড়া তুলোর মতো হালকা বরফ পড়ছে অফুরন্ত। আর আমি ভাবছি এই বরফে প্লেনটা ছাড়বে তো?
ঠিক পাঁচটায় একটা গাড়ির হেড লাইটের আলো দূর থেকে আসতে দেখে নড়ে চড়ে বসলাম। এই সেই ট্যাক্সি যা আমাকে আরলান্ডা এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।

   



Friday, January 4, 2019

ইয়োরোপ আবারো


হোটেলের রিসেপশনে জাহাজ থেকে নেমে রাস্তা পেরিয়ে একটা ছোট্ট বাড়িতে। স্লট মেশিনে পয়সা ঢুকিয়ে একটা কফি নিয়ে নেটে বসলাম। ইন্টারনেট ফ্রি এখানে। এত কিছুর মধ্যে আমি আমার কোনো বাংলা কবিতার বই আনিনি। বাংলায় কবিতা পড়তে বললে তো সর্বনাশ। বাড়িতে ছোটুকে মেল করলাম চট করে কয়েকটা কবিতা স্ক্যান করে পাঠিয়ে দে। রঙিন আরশোলা, খরকাই টরকাই যেন থাকে। এ দুটো কবিতা এরা সুইডিশে অনুবাদ করেছে। অনুবাদের কাজটা হেনরি আর বোয়েল দুজনে মিলে করেছে।
পরের দিন সকালে কবিতাগুলোর প্রিন্ট আউট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহরটাতে। ভোরের দিকে অল্প বরফ পড়েছে। রাস্তাঘাট সাদা হয়ে আছে। তার সঙ্গে তীক্ষ্ণ হাওয়া। গেঞ্জি, উলিকট, জ্যাকেট ভেদ করে হাড়ে গিয়ে ধাক্কা মারছে যেন। টুপি মাফলার ঢাকা মুণ্ডুটার যেটুকু অংশ খালি আছে, মনে হচ্ছে যেন কেউ গাল থেকে টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে রক্ত মাংস মেদ। এখন বুঝতে পারছি কেন হেনরি গতকাল রাতে আমাদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে উলটো দিকে ঘুরে দাড়াচ্ছিল, আর সমানে বলছিল, I am not properly dressedহাঁটু অবধি চামড়ার জুতো পরা রমণীরা দ্রুত টক টক আওয়াজ তুলে আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। এই ঠাণ্ডায় আম-বাঙালির মতো দুলকি চালে হাঁটাটা অসম্ভব বুঝে আমিও চলার স্পিড বাড়ালাম।










রাস্তাটার একটা বাঁকের মুখে ন্যাশনাল মিউজিয়াম। সোজা ঢুকে পড়লাম। টিকিট একশো কুড়ি সুইডিশ ক্রোনা। রাজারাজড়ার আমলের আসবাবপত্র ছাড়া ইন্টারেস্টিং কিস্যু নেই। আর কাঠের মেঝের ক্যাঁককো ক্যাঁককো করে সমানে আওয়াজ করার প্রবণতায় খানিকটা মজা লাগছিল বটে। বরং মিউজিয়ামের একতলার বইয়ের দোকানটা দারুণ। তবে বইপত্রের যা দাম ইচ্ছে থাকলেও ট্রিপের শুরুতেই কেনাকাটার সাহস পেলাম না। সেইতো ফেরার সময় স্টকহোম থেকেই প্লেন ধরতে হবে তখন ভাবা যাবে।
তেড়ে খিদে পেয়ে গেছিল। ইয়োরোপ চষে ফেলা গৌরবের পই পই মনে পড়ে গেল। খবরদার হোটেলে ঢুকে খেতে যেও না। প্রচণ্ড দাম। সোজা একটা সুপারমার্কেটে ঢুকে যা দরকার কিনে নাও। তারপর পার্কে বসে খাও।
এই ঠাণ্ডায় পার্কে বসে খাওয়ার মতো হিমগিরিকা বীর আমি নই। অতএব একটা বড়কা স্যান্ডউইচ কিনে চালান করলাম কোটের পকেটে। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখলাম সারি সারি দোকান। গ্লোবালাইজেশনের দৌলতে এসব জিনিসই আমাদের কোলকাতার শপিং মলগুলোতেও দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীর সমস্ত শপিং মলের ব্র্যান্ড ভাগ্য প্রায় একই।
কাঁটায় কাঁটায় চারটের সময় ফোন। বোয়েল। হ্যালো, তুমি তৈরি? তৈরিই ছিলাম। গ্রাফিত্তির কালো ঝোলা তুলে বেরিয়ে পড়লাম। ঠাণ্ডা হাওয়ার চোটে নাক চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াতে শুরু করল ধারায়। বোয়েল আর আমি গতকাল যে হোটেলটাতে খেয়েছিলাম তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হোটেল থেকে সেটা মিনিট পাঁচেকের পথ কিন্তু মনে হচ্ছিল বহু যুগ ধরে হাঁটছি। নাক মুখের অস্তিত্বই টের পাচ্ছিলাম না। রুমাল নিয়ে জল মুছতে গিয়ে পেলাম একটা ভার্চুয়াল মুখের অস্তিত্ব। পরে জেনেছি সেদিন ছিল মাইনাস টু। নভেম্বরেই এই, ডিসেম্বরে কী হয় কে জানে। কোনো ইয়োরোপিয়ানকে বলতে শুনিনি তাদের শীত ভালো লাগে। এখানে আসার আগে অবধি শীত আমারও ভালো লাগত, এখন আর লাগে না। এই শীত মৃত্যুর মতো কঠিন।
কালচারাল সেন্টারে পৌঁছে প্রথমেই এক কাপ গরম কড়া কালো কফি অর্ডার দিলাম। বিরাট এই কালচারাল সেন্টারের লাইব্রেরীতে আমার কবিতা পাঠ। অ্যাটমোশফিয়ারটা একটা ক্ল্যাসিকাল কফি শপের মতো, বই পড়াও চলছে, কফি খাওয়াও। তার সাথে চাইলে হালকা স্ন্যাক্সও। গরম কালো কফি পেটে পড়তে খানিকটা ধাতস্থ হওয়া গেল। সাউথ আফ্রিকান কবি গ্যারি কামিস্কির বন্ধু ডারবানের প্রভাসন পিল্লাই অধুনা কর্মসূত্রে স্টকহোমে, তার আসার কথা আমার কবিতা পাঠে। আমেরিকান লেখক ডগ ম্যাথিউসনের বন্ধু জেলেনারও আসার কথা এই অনুষ্ঠানে।
শুরুতে ঠিক হলো শর্মী পাণ্ডের শর্ট ফিল্ম ‘মাই হোম’ দেখানো হবে। এখানে অভিনেতা শুভঙ্কর। ভাবা যায়। পাঁচ মিনিটের এই ফিল্মটি এখন অস্ট্রেলিয়ার কবিতা প্রজেক্ট Memory Video Project-এ পৃথিবীর অন্যান্য আরো ১৩টা ফিল্মের সঙ্গে সংকলিত হয়েছে। ফিল্ম দেখানোর পর শুরু হলো অনুষ্ঠান। আমি একটা করে কবিতা ইংরেজি অনুবাদে পড়ছি আর তার সুইডিশ অনুবাদ পড়ছে সুইডিশ কবি নাট্যকার বোয়েল শেনলেয়ার। বোয়েল আর হেনরি দুজনে মিলে আমার কবিতা সুইডিশে অনুবাদ করেছে। বোয়েল হঠাৎ ম্যাজিকের মতো তার ব্যাগ থেকে আমার কয়েকটা বাংলা কবিতার বই বের করে তার থেকে বাংলা কবিতা পড়তে অনুরোধ করল। প্রাথমিক চমক কাটিয়ে ‘একা একা চুমকুড়ি একা একা প্রপালশন আরামের’ বইটি থেকে কবিতা পড়তে শুরু করলাম। প্রচ্ছদের মজাটাও বললাম শ্রোতাদের। বইটার নাম শুরু হচ্ছে ব্যাক কভার থেকে, শেষ হচ্ছে ফ্রন্ট কভারে। প্রশ্ন এলো তাহলে কি বইটা পেছন থেকে শুরু?
হেসে বললাম – না, তা নয়।

















এভাবেই প্রশ্ন উত্তর শুরু হলো। গ্রাফিত্তি কোলকাতার ইংরেজি কাজকর্ম নিয়ে, আমাদের চিন্তা ভাবনা থেকে শুরু করে কোলকাতার কালীঘাটের কালী অবধি চলল ব্যাপারটা এবং সেই সূত্রে তন্ত্র, শক্তি, ইন-ইয়াং ফোর্স ইত্যাদি। এরপর আবারো আমরা ফিল্মে ফিরলাম। শর্মীর 29 minutes of loneliness. তুমুল হাততালি আর অ্যাপ্রিসিয়েশনে মন ভালো হয়ে যাচ্ছিল।
এবার মঞ্চে এলেন একজন সুইডিশ আর্টিস্ট পনটাস রাউদ। এসে তিনি একটা গল্প বলতে শুরু করলেন। কীভাবে সংস্কৃত উচ্চারণে বেদ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রের ধ্বণি মূর্ছনার গতিতে কয়েকজন পেইন্টিং করেছিলেন। সেই Vedakurt ( it is made out of Veda and Kurt, where Kurt means a card but also a picture) তিনি আরেকবার ব্যাপারটা স্টকহোমের লাইব্রেরীতে করতে চলেছেনআমি বাংলায় কবিতা পড়ব আর উপস্থিত আগ্রহী সবাই ছবি আঁকবেন।
টি এস ইলিয়ট তার ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতায় বেদের যে লাইনগুলো ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো আরেকবার আমি উচ্চারণ করলাম –
asto ma sat gamaya
tamaso ma jyotir gamaya
mrityor ma amritam gamaya
om shanti, shanti, shanti.
Deliver us from the darkness to the light…
From the illusion to the truth…
Let there be peace peace peace

শুরু হলো Vedakurt.
প্রায় ঘন্টা খানেক বাংলা কবিতা পড়লামপাঠ শেষে সব থেকে ইন্টারেস্টিং ছবি যা আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল তা হলো পনটাস, বোয়েল আর হেনরির।



                            পনটাস রাউদের আঁকা সেই ছবি



                             হেনরি দিনান্দারের আঁকা সেই ছবি



একজন ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বুঝতে পারছি কথা বলতে চাইছেন কিন্তু ইতস্তত করছেন। বাংলাতেই জিজ্ঞাসা করলাম – অপনি বাঙালি তো? একটা সলজ্জ হাসি হেসে হ্যাঁ বললেন। কোলকাতার মেয়ে। বাংলা কবিতা শুনে ছুটে এসেছেন।
বহুদিন পর বাংলায় কবিতা শুনলাম। খুব ভালো লাগছে জানেন।
বোয়েলের সাথে তাকে আলাপ করালাম।
দেখো আমার শহরের একটা মেয়ে।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও সুজোগ হলো না। অন্যান্যরা এগিয়ে এলো।
আমি কোলকাতায় গেলে দেখা হবে নিশ্চয়ই।
মাথা ঝুঁকিয়ে হেসে বিদায় নিলেন।
প্রভাসন আর জেলেনার সাথে আলাপ হলো। জেলেনা একগুচ্ছ কবিতা উপহার দিলো আমায়। যার একটা এরকম –
Her skin gives off a faint scent of something familiar,
but he cannot put a finger on what it is.

Vanilla sugar milk baby powder cocaine

White. She smells of something white. And white she is,
white as snow high up in the mountains, 
untouched by city smog, unspoiled by traces of urine. 

She says that her heart and thoughts are black as coal,
but he does not care. He feeds on the light coming from
her skin.

(Under the Triple moon/disenthralled, June 2010)

আর প্রভাসন আমার দিকে এগিয়ে দিলো গ্রাফিত্তি কোলকাতা থেকে প্রকাশিতব্য গ্যারি কামিস্কির কবিতার বই ‘Sky Dreaming”-এর প্রচ্ছদের হার্ড কপি, প্রচ্ছদের পুরো কাজটাই করেছে জেনি।  আর টিরুম বুক্স প্রকাশিত গ্যারি কামিস্কির কবিতার বই Romancing the Dead প্রভাসন পিল্লাই আর জেনি কেলারম্যান পিল্লাই দম্পতি সাউথ আফ্রিকার একটি ছোট প্রকাশনা টিরুম বুক্স চালায়। সাউথ আফ্রিকার ডারবানের আরো একটি ছোট স্বাধীন প্রকাশনা এই টিরুম বুক্স। এই স্বাধীন প্রকাশনা আর লেখকদের একটা কমিউনিটি সারা পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে। আজকে আমরাও তাদের একটা অংশ ভাবতে বড় আনন্দ হচ্ছিল। হাত ছুঁয়ে প্রভাসনকে ধন্যবাদ জানালাম। আর জেলেনা আমার গালে একটা চুমু এঁকে দিলো।
ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম হৈ হৈ। এবার মদ্যপান।






 এরিখ বলে একটি ২০-২২ এর তরুণ ছেলে সমানে তার মুভি ক্যামেরায় আমার ছবি তুলে যাচ্ছিল। এবং সেটা হোটেলের ঘরে ফেরা অবধি। ছেলেটা বারোজ ভক্ত। কাট আপে কবিতা লেখে। এক ধরণের wordrap দারুণ musical . এই ফিল্মটা হয়ত কখনো You Tube-এ ও পোস্ট করবে তখন পাঠক এই (wordrap)-এর মজা উপভোগ করার জন্য আপনাদের আগাম আমন্রণ রইলো। ফিল্মের কাট আপের সঙ্গে শব্দের কাট আপের মজার খেলায় আপনারাও অংশ নিতে পারবেন।



                            সেই বারোজ ভক্ত এরিখ

পরের দিন দেখি জেলেনা আমাকে একটা মেল করেছে –
Hej Subhankar,

Thank you for a lovely evening yesterday! We are sorry we could not follow afterwards, it would have been great to have a dinner together, but there was no way for us to make it.  I’ve been at work for some time now, and will work until late this evening.
One thing, I am not sure if Pontus explained it, Swedes often forget that not in all other languages you can  build words of putting them together without – separator and similar. So, when he used ‘Vedakort’, it was made out of ‘Veda’ and ‘Kort’, where ‘Kort’ means a card, but also a picture. Those girls he talked about (his inspiration for the workshop) listened to chanting in Sanskrit while they were painting pictures. Therefore ‘Vedakort’.
Sweden is lovely in summer, now it is so dark and cold. I guess you were around Gamla Stan? If you have time, maybe see Vasa museet http://.www.vasamuseet.se/en/? It is just an old ship but it is interesting.

Have anice trip and good day in Stockholm!

Cheers

Jelena
Friday, Nov 19, 2010.

 পনটাস রাউদ অবশ্য আমাকে জানিয়েছিল ওটা Kort নয় Kurt এবং জেলেনার এই ম্যাজিকাল ব্যাখ্যাটাও তাতে টেকে না। পরে জেলেনা আমাকে এটা নিয়ে আরেকটা মেল লেখে। 


Hi Sub,

I am fine, thank you! :) It is quiet a cold winter, I am all set in spring coming, but I guess I will have to wait for few more months.

About Vedakort - now you have to know that I am a bit fuzzy in my head, but I am aware of that, so I am trying to filter and fix the result of my thoughts most of the time.

So, now when you know that about me - I wrote you this before (found in my mailbox)  :) 'One thing, I am not sure if Pontus explained it, Swedes often forget that not in all other languages you can build words of putting them together without - separator and similar. So, when he used 'Vedakort', it was made out of 'Veda' and 'kort', where 'kort' means a card, but also a picture. Those girls he talked about (his inspiration for the workshop) listened to chanting in Sanskrit while they were painting pictures. Therefore 'Vedakort'.

But...I double checked that with my husband today (he is a Swede born in Stockholm). and he thought that I was wrong - the explanation he offered was :

'...so, when Pontus used 'Vedakort', it was made out of 'Veda' and 'kurt', where 'kurt' was the guy's name'.

So, the Swedes do put the names and a few words together building in one word , but this one was actually boring, it was just Veda and the guy's nane. I guess I have some imagination and I misheard kurt for kort and built my associations pretty freely. I am so sorry. But good that I checked with Joakim who speaks the same dialect as Pontus, he is certainly right with his explanation :) Now you know the truth, sorry for deceiving you, it was not on purpose.

I said to Joakim - 'but we both laughed vedakurt/kort back that evening, mine was not funny for real...although pretty much all made up'.

So, please do not write the vedakurt thing, since half of it was only in my head.

Oh, Sub. I am sorry if it does not make much sense.

But on the other hand - I am really glad if you liked something I wrote. I would be very happy and honored if you weant to use it. Whichever piece you like. I wanted to spend more time and get to know you when you were here, but I had no time because I had to go home and inject my medication. But , there was a lot of people you knew from via mail and their and your work, it was certainly nice to meet them IRL. I am happy I got to meet you anyway.

I saw you were in Athens and had a good time there. I love Greece, have such nice memories from there. We used to go there for vacations when I was a child with my parents. I was  born and raised in Serbia, and Greece was close. Wonderful people witjh lot of warmth and quite a temper! And so friendly.

Also, I read the poetry you publish which I found on the net. I loved in particular one poem from Doug yopu published last year, he must have written that one when his mom was sick and dying.

I would be very much interested in one of your projects, please keep in touch

Hugs
Jelena
January 2011

এসবের পরেও জেলেনা কবি বলেই তার ব্যাখ্যাটাই আমার কাছে প্রিয়। কারণ সে ছবি লেখে। আর পনটাসের ব্যাখ্যাটা সত্যই বোরিং জেলেনা। হেই জেলেনা ধন্যবাদ। পুরোনো জাহাজটা আর দেখা হলো না এবার। গামলা স্ট্যানের ওল্ড টাউন দারুণ। বাড়ির জন্য সুইডিশ মার্মালেড কিনেছি দুজন বয়স্ক ভদ্রমহিলার থেকে। বো্য়েলকেও কিনে গিফট করেছি। জানতো বোয়েল ভেগান আর আমি প্রবল মাংসাশী তাই সে আমাকে নিয়ে গেল এক সসেজের দোকানের সামনে। দেখি উপর দিকে টাঙানো রয়েছে বিশাল বিশাল লাল সসেজ। 
ওটা কী বলতো? -সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে। 
কী? -আমি জানতে চাই।
 ওগুলো রক্ত ভরা সসেজ। তোমার মতো মাংসাশী লোকেরা খুব কেনে।
শুনে বমি ঠেলে উঠে আসছিল পেটের ভেতর থেকে। ছুটে মার্কেট থেকে বাইরে এলাম। বাইরে একটা দোকান থেকে মন ঠিক করার জন্য কিনলাম একগাদা পিকচার পোস্টকার্ড। আর পাথুরে রাস্তার উপর হলুদ আলোর মায়া পকেটে ভরে চললাম। কাল ভোরে এথেন্সের প্লেন ধরছি। এই ঠাণ্ডায় আর স্টকহোমে থাকতে পারলাম না। হয়ত কোনোদিন গরমের সময় দেখা হবে বন্দুগন।