আজও কালাচাঁদ বারান্দায়
বসে আছে। বসে বসে দুলছে আর সমানে বক বক করে চলেছে সেই অদ্ভুত ভাষায়, যে ভাষায় ও
কথা বলে। লোকে বলে কালাচাঁদ যমের চেলা। মৃতের হাত ধরে সে নিয়ে যায় সেই পাহাড়ে যেখানে মৃতদের বাস।
সে পাহাড় অন্ধকার। আলো জ্বালাবার কেউ নেই। এসব জেনেও আমার তাকে ভয় করে না কারণ সেও
পুরুষ। আমার ব্যথা, ব্যর্থতা সেই বোঝে ঠিকঠাক। তার জন্য খুব একটা ঘ্যান ঘ্যান করতে
হয়না তার কাছে।
সকালের এ সময়টা আমি তাকে মুড়ি দি। সে লাফিয়ে
লাফিয়ে খায় খুঁটে খুঁটে। আর আমার দিকে মুখ তুলে অম্লান বদনে ডেকে ওঠে—ক্রর ...
ক্রর ... আমি সে ভাষা বুঝিনা যদিও। বুঝবার চেষ্টায় একটা কাকচরিত্র কিনে এনেছিলাম
ফুটপাত থেকে কিন্তু তাতেও সুবিধে হয়নি কিছু। একা মানুষের কথা বলার সঙ্গী সে এখন।
যেখানে কথা বলে চলাটাই আসল। দেওয়ালের সাথে তো আর কথা বলা যায়না, হাত বুলিয়ে আদর
করা যেতে পারে চুপি চুপি। কারণ লোকে দেখলে ভাববে ব্যাটা ভাবছে অন্ধ হয়ে যাবে তাই
এখন থেকে প্র্যাকটিস করছে।
এই দেওয়ালের সাথে আমি কথা বলার চেষ্টা করে
দেখেছি বড় বিরক্ত লাগে। তাই কেউ কারো ভাষা না বুঝলেও হাবেভাবে একে অপরকে সুখ
দুঃখের কাহিনী জানাচ্ছি আর কী। দেবলা আজ দেরি করছে আসতে। বাসনপত্র মেজে ঘর ঝাঁট
দিয়ে মুছে চলে যাওয়ার পর রান্না ঘরে ঢুকে দুফুরের রান্না সারতে হবে। একটা বউ থাকলে
কী ভালো যে হত।
এসময়টা কাকেদের বাসা
বাঁধবার। আমার বারান্দার টবে শুকিয়ে ওঠা তুলসি গাছের ডাল ধরে টানাটানি দেখেই
বুঝেছিলাম। কালাচাঁদ অবশ্য এইসব বাসা বাঁধবার ন্যাকামি দেখলে বিরক্ত হয়। শুধু
বাচ্চা বানাবার জন্য বাসার আবার কী দরকার? মানুষ না হয় গাছের ডালে থাকতে পারে না।
মাথা গোঁজার ঠাই তার একান্ত প্রয়োজন। তোরা সারাটা বছর গাছের ডাল, বাড়ির কার্নিশে,
বারান্দার গ্রিলে কাটিয়ে দিলি যত বাসা শুধু বাচ্চা পাড়বার সময়? আমি তাকে বলি- না
হে বাচ্চার জন্যই বাসার দরকার। আড়াল দরকার। সাবধানতা দরকার।
এ জীবনে কেন যে পাখি হওয়া
গেল না, একথা মনে মনে ভাবি। পাখি হলে ওই অনন্ত আকাশে ডানা মেলে ভরপুর ভালোবাসা
যেত। পাখিদের হাজার বায়ানাক্কা নেই। তারা বাসা বাঁধে আর ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে
বাচ্চারা চিঁ চিঁ করে খেতে চায়। মা বাবার কাজ তখন খাওয়ার মুখে করে এনে একটু চিবিয়ে
বাচ্চাদের মুখে দেওয়া, যাতে গলায় আঁটকে না যায়। এতে তাদের প্রেম কমে যায় বলে আমার
জানা নেই। বাচ্চারা উড়তে শিখলে একদিন সেই বাসা ফেলে চলে যায় অন্য কোথাও। আর ফিরে
আসে না। আমার ঘরের তাকে সেইসব ফেলে যাওয়া বাসা আমি একা একা পাহারা দিয়ে দেখেছি
তারা ফেরেনি আর।
আমার বাসার কার্নিশে,
সামনের ফ্ল্যাটের বারান্দায়, এসি মেশিনের উপর দেখেছি কত পায়রাদের ঠোঁটে ঠোঁট
ডুবিয়ে চুমু খেতে। মেয়ে পায়রাটি অল্প নিচু হয়ে অপেক্ষা করে কখন পুরুষটি তার উপর
উঠে বসবে। এ নিয়ে তাদের কোনো ভণিতা নেই। আমাদের এইসব নানান কায়দায় ওঠা বসা থাকলেও
বাচ্চার ব্যাপারে আমরা দারুণ হিসেবি। অন্তত আমার প্রথম প্রেমিকা তাই ছিলো। পরে
অবশ্য জানতে পেরেছিলাম তার আসল কারণ।
আমি তখন মাদ্রাজ থেকে
চাকরি বাকরি ছেড়ে কবিতা লিখব বলে ফিরে এসেছি কলকাতায়। অর্থাৎ এটা বহুদিন আগের কথা
যখন মাদ্রাজ চেন্নাই হয়নি, তখনও লোকে বিশ্বাস করত বিপ্লবে, হাতে হাতে মোবাইল ফোন
সহজলভ্য হাতের মোয়া হয়ে ওঠেনি। তখনো লোকে কাগজে লেখা দিস্তে দিস্তে প্রেম পত্র
পাঠাত। কখনও সবুজ, কখনও নীল কালিতে লেখা। সাথে স্মৃতি হিসেবে একটা গাছের পাতা,
ফুলের পাপড়ি বা মাথার একটু কাটা চুল। তখনও বাবা মা মহাভারত রামায়ণ অনুপ্রাণিত হয়ে
ছেলের নাম রাখত অর্জুন, পার্থ, অভিজিৎ বা নেহাত শঙ্কর। তখনও সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা
দখল নেয় নি মা-মাসীমাদের আড্ডার, পান চিবনোর অলস সময়গুলো। তো এমন একটা সময়ে রবীন্দ্র
সদনে খুব ভোরে তার সাথে দেখা ২৫ শে বৈশাখ। আমি যথারীতি কোনো লিটল ম্যাগাজিন মাটিতে ফেলে বিক্রি
করছি। একটা হলুদ লাল পাড় শাড়ি পরে সে এলো। স্বর্গের কোনো এক কোণ থেকে একটা আলো
তেরছা করে মুখে এসে পড়েছিল তার। সে নিজেই পায় পায় আমার দিকে এগিয়ে এসে পরিচয় দিলো।
- ‘আমি মৌ। আপনারা এই কাগজটা করেন? আমি আগে পড়েছি। আমি তো
ফ্যান এটার’।
আমি তার মুখের
দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে সে মিষ্টি করে হেসে আমার নাম জিজ্ঞাসা করে।
-‘আমি শঙ্কর।
আমরা চার পাঁচ জন মিলে এই কাগজটা করি। আপনি কি লেখেন’?
-‘ওই একটু আধটু
চেষ্টা করি। আপনাদের মত অত ভালো পারি না’।
-‘একটু চা খাবেন
নাকি’?
সে ঘাড় নেড়ে সম্মতি
জানায়। ওই শুরু। তারপর বার বার দেখার ইচ্ছে, একসাথে আরো আরো থাকার ইচ্ছে বাড়তেই
থাকে আমাদের। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গাছের তলা, টাটা সেন্টারের সামনের মাঠের ঘাসে কেটেছে
কত বিকেল সব। মৌ খাতা থেকে ছেঁড়া কাগজে প্রেমপত্র লিখে আমাকে দিয়েছে। তার উত্তরও
দাবী করেছে। সেইসব চিঠি কোথায় হারিয়ে গেছে এতদিনে। থাকলে এই লেখাটার সাথে জুড়ে
দেওয়া যেত। ঝড়ের মত কেটে যাওয়া দিন সব। এই সময় আমার এক বন্ধু বুটা আমাকে দেখে ফেলে
রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে।
-‘কীরে মেয়েদের কলেজের
সামনে মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে থাকিস। ব্যাপার কী’?
আমরা তখন ঘোরতর বামপন্থী।
আর এই বামপন্থায় কীভাবে যেন আমরা এনে ফেলেছিলাম ভারতীয় সনাতন বাল-ব্রহ্মচারিত্ব।
অর্থাৎ বামপন্থী হলে প্রেম বিয়ে করা চলে না। পুজোতে নতুন জামা পরাও অপরাধ। পরলে
আওয়াজ খেতে হয় – ‘কি নতুন জামা চড়িয়েছ পুজোতে’। অবশ্য তখনও আমি চে গে ভারার এই কথাটি জানতাম না- "Love is the first condition to be a revolutionary". অবশ্য জানলেও খুব লাভ কিছু হত না। চে কে লোকজন বলত একটা পাগল।বামপন্থার সিদ্ধাই তার কই! স্তালিন না হোক অন্তত কাস্ত্র তো হতে পারত। তাই বুটার কাছে এ নিয়ে ঝাড় খাওয়ার আগে বলি
-‘আরে আমাদের ফিল্ম
ক্লাবের শো হয়ত ওখানে, খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম’।
-‘কেন তোকে পোস্টকার্ড
পাঠায়নি’ ?
-‘না রে। যা অবস্থা
ডাকবিভাগের, কার চিঠি কার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে কে জানে’।
আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হয়
বুটা। আমিও সাবধান হই। ওখানে ওভাবে আর দাঁড়ানো যাবে না।
এখন ওকথা ভাবলে হাসি পায়
কিন্তু তখন ও সময়টা এরকমই ছিল। সিনিয়ার লেখকরা কতদিন রাস্তাঘাটে পড়া ধরেছেন – ‘বলতো
দন্দ্বমূলক বস্তুবাদ কাকে বলে? এটাও জাননা তোমরা আবার আঁতেল? মার্ক্সসিজিম বিজ্ঞান,
এটা তোমাদের বুঝতে হবে। এটা এড়িয়ে
লেখালিখি করা চলে না। সমাজে বাস করে সমাজ কে এড়িয়ে চলতে পারোনা। মানুষ তোমায় ক্ষমা
করবে না’।
এসব আমরা বিশ্বাসও করেছি,
আবার অবিশ্বাস করেও ভয় ভয়ে মেনেও নিয়েছি। স্তালিন, হিটলারের মানুষ মারার রেকর্ড যে
প্রায় এক তখনও তা জানতাম না।
তো আমরা ঠিক করলাম এভাবে
চলতে পারে না। আমার মুদিয়ালি বাড়িতেই এবার দেখা সাক্ষাৎ হবে আমাদের। আর তাছাড়া
আমরা তো ঠিকই করেছি একসাথে জীবন কাটাব। আমার মা অবশ্য পছন্দ করেন নি আমার পছন্দের
মেয়েকে। তাতে অবশ্য আমার কিছু এসে যায়নি তখন কারণ চিরকালই অন্যের কথা শুনে চলার
বান্দা আমি নই। আমার ঘরটা ছিল নিচের তলার এক কোণে। দুফুর বেলাটা কেঊই থাকত না কাছে
পিঠে। শুধু আমি আর মৌ। একা ঘরে দুজন তরুণ তরুণী থাকলে যা ঘটতে পারে তাই ঘটে চলল
দিনের পর দিন। আমরা একে অপরের শরীর কে জানলাম চিনলাম। ততদিনে জেনে গেছি আরও একটি
পুরুষ এই শরীরটাকে ভালোবাসে। তার নাম কেষ্ট। বইমেলাতে মাঠে বসে আড্ডা মারার ছবিতে
সেই কেষ্টকে দেখলাম। পাতলা দোহারা চেহারা। কোঁকড়া এক মাথা চুল। আর কারা কারা যেন
ছিল সেই ছবিতে। ওই মেয়ে ঝুমা তো ছিলই। সেই প্রথম বার তার শরীর ছুঁতে গিয়ে শাড়ির
তলায় সায়া, তার তলায় মায়ার বদলে দেখি ইজের। সেই ইজের সরিয়ে তার ছোট্টো জমিদারী
দেখার লোভ আমার কেমন যেন চলে গেল সেই দিন। তার উপর মৌ ঝটিতি উঠে বসে-‘তোমারটা
দেখি-‘ বলে আমার জিন্সের প্যান্ট নামিয়ে দু মুঠোতে আমারটা ধরে চুমু দিতে দিতে বলল –‘তোমারটার
থেকে কেষ্টরটা অনেক বড়।‘ এটা শোনার পর মনে হচ্ছিল মাথাটা কেমন শূন্য হয়ে গেছে।
সারা শরীরে আর জোর নেই কোথাও। তবু ভালবাসলে মানুষ সব মেনে নেয়। মেনে নিতে চেষ্টা
করে খুব। এরপরও আমাদের প্রেম থামেনি। তো এরকম চলতে চলতে একদিন সে মুখ কালো করে
এলো।
-‘কী হয়েছে? এরকম করছ কেন’?
-‘আমার মনে হয় আমি
প্রেগন্যান্ট’।
-‘কী ভাবে বুঝলে’?
-‘মেয়েরা বুঝতে পারে’।
-‘বেশ তো। চলো বিয়ে করি’।
-‘পাগল নাকি? নিজের পায়ে
না দাঁড়িয়ে বিয়ের কথা আমি ভাবতেও পারিনা। দরকার হলে আমি বাচ্চা নষ্ট করব’।
-‘কী বলছ যাতা। আগে তো
পরীক্ষা করে দেখ’।
ক্লিনিকে যাওয়া হল তারপর।
আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে সে ভেতরে গেল। তার কাছে পরে শুনেছি তার ইউরিনের সাথে একটা
কেমিকাল ঢালতেই টেস্ট টিউবটার ভেতরের তরল নীল হয়ে গেছিল। আমার রাজকুমার তার ভেতরে
বাড়ছিল রোজ একটু একটু করে। কিন্তু তাকে পৃথিবীর আলো দেখানো যাবে না।
-‘কেন এরকম করবে? একটা
বাচ্চাকে মেরে ফেলবে? ওর কী দোষ’?
-‘ঝুমা কী ভাববে বলতো’?
-‘মানে? আমাদের বাচ্চার
সাথে ঝুমার ভাবাভাবির কী সম্পর্ক’?
-‘আমি ঝুমাকে ভালোবাসি
ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না’।
সম্পর্কের এই জটিলতা
ছাড়াবার উপায় আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একটা মেয়ের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে আমায়?
এটা কি আদৌ করা সম্ভব? আমি ওকে আটকাতে পারলাম না বহু চেষ্টা করেও। বাচ্চাটা নষ্টই
করলো মৌ। কদিন পাগলের মত ঘুরলাম রাস্তায় রাস্তায়। খালাসিটোলায় মদ খেয়ে দুঃখ কমাতে
গিয়ে দেখি শালারা আমার থেকেও চালাক হু হু করে বেরিয়ে আসছে চোখ দিয়ে। মৌ এসব পাত্তা
না দিয়ে ঝুমা আর তার ভালোবাসার কাহিনী শুনিয়ে চলল আমায়। আমি এসব শুনে কী করব কিছুই
বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মৌ আমাকে বোঝাল কী করতে হবে আমায়।
ভালবাসলে মানুষ সব মেনে
নেয়। মেনে নিতে চেষ্টা করে খুব। তাই আমিও তার কথা শুনে ঝুমাকে কীভাবে ফেরানো যায়
সেই কথা ভাবতে বসলাম। এছাড়া কীবা করতাম। আমার কাঁধে মাথা রেখে মৌ কাঁদছে হু হু
করে। তার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে আমার সিল্কিনা জামার কলার। শত জড়িয়ে আদর করে চুমু
খেয়েও সে দুঃখের বন্যা থামাতে পারছিনা আমি। এই ভালবাসার কাছে আমার সমস্ত আদর
ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে।
যাদবপুরে ঝুমা থাকত। তাকে
আমি চিনিওনা। তবু তার বাড়ি গেলাম একদিন, যা আছে কপালে, এই কথা ভাবতে ভাবতে। আমার
সাথে ভদ্রতা করে সে দু মিনিট কথা বলল বটে কিন্তু পরিষ্কার জানিয়ে দিল এভাবে সে
ভাবে না মৌ কে নিয়ে। আমি তাকে তখন কী করে বলি সেই পিকনিকের রাতের ঘটনা। যখন তারা
এক চাদরের তলায় শুয়ে আদর করেছিল একে অপর কে। এখন বুঝি সেটা ছিল শুধুই একটা রাতের
কাহিনী আর কিছু নয়। কিন্তু এই সত্যটা মুখ ফুটে আমি মউকে বলতে পারিনি। বেচারি নিতে পারবে
না। ফিরে এসে বললাম –‘ও তোমার সাথে যোগাযোগ করবে বলেছে।‘।
তারপর যা হয় আরকী আমাদের
সম্পর্ক ফিকে হতে থাকল। নিজেকে মনে হতে থাকল আনওয়ান্টেড । কি করছি আমি এখানে? কেন
করছি এসব? বোকামিরও তো একটা লিমিট থাকে। আমার ছিল না। এখনও যে আছে বলতে পারিনা সে
কথা। কালাচাঁদ কে জিজ্ঞাসা করি – হ্যাঁ রে তোর কী মনে হয়?
-‘ধুর বোকা, এই যে তুই
আমার নাম রেখেছিস কালাচাঁদ মানে চিকন কালা কানু অর্থাৎ তোর ভিতর একটা রাধা ভাব
জেগে উঠছে, তা কি আর এমনি রে’ –বলে কালাচাঁদ উড়ে চলে যায়।
দেবলাটা যে কী করছে কে জানে। আসবেনা নাকি?