Thursday, November 23, 2017

লেখা নিয়ে বাতেলা-চার্লস বুকাওস্কি

















বুকাওস্কি জন্মেছিলেন আন্দেরনাখ, জার্মানিতে। তিন বছর বয়সে বাবা মা’র সাথে আমেরিকা চলে আসেন। বড়ো হয়ে ওঠেন লস অ্যাঞ্জেলস-এ যেখানে তিনি জীবনের পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছেন। জীবনে বহু রকম কাজ করেছেন। পোস্টঅফিসের ক্লার্ক থেকে মুটেগিরি অবধি। কিন্তু কোনটাতেই বেশিদিন টিকতে পারেননি। তাই অনেকসময় অনাহারে কাটাতে হয়েছে। একটা ক্যান্ডিবার আর শুধু হাফ বোতল সস্তা ওয়াইন দিয়ে তিন-চারদিন কাটিয়ে দিয়েছেন মাঝে মধ্যেই।
অনেকসময়ই সততার সঙ্গী হয় কৌতুক রসবোধ। বুকাওস্কি প্রথমেই নিজেকে নিয়ে মজা করতে ভালবাসতেন, যখন তিনি কৌতুক করতেন চারপাশের উন্মাদ পৃথিবীটা নিয়ে। এই উচ্চাঙ্গের অ্যাবসার্ডিটির চেতনা তার সমস্ত প্রকাশিত লেখার মধ্যেই দেখা যাবে। সম্ভবত চ্যাপলিন বলেছিলেন সেই আধুনিক মানুষ যে নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারে। যা সারাটা জীবন করে দেখিয়েছেন চ্যাপলিন।
বুকাওস্কির প্রিয় রঙ ছিল হলুদ। রঙের প্রিয়তা দিয়ে মানুষের মানসিকতা নাকি বোঝা যায়, বলে লোকে। আরো কত কী যে বলে লোকে অথচ তিনি ভালোবাসতেন জানালার খড়খড়ি বন্ধ করে দুপুর অবধি টানা ঘুমোতে। সন্ধে থেকে ভোর রাত অবধি চলত তার লেখালেখি, রেডিয়োতে ক্ল্যাসিকাল চ্যানেলে বাখ, বেটোভেন, শুবার্ট শোনা আর বিয়ার খাওয়া। তিনি খুব ভালোবাসতেন ভারতীয় বিড়ি। জীবনের শেষ ২০-২৫টা বছর রাজস্থান থেকে যাওয়া ‘শের’ বিড়ি খেয়েছেন তিনি। যদিও তা তাকে ভারতে আসতে উদ্বুদ্ধ করে নি। লোকে বলে তিনি নাকি বিট জেনারেশনের। আর এই বিট জেনারেশনের অনেকেই শান্তির খোঁজে ভারতে এসেছেন বার বার এ কথা তো আমরা জানি। জানাজানি এ কথা। এমনকি গিন্সবার্গ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ভারত থেকে ফেরার পর এবং কবি বব রোজেন থাল আরো জানিয়েছিলেন যে তার মৃত্যুর পর তাকে দাহ করা হয় এবং সেই ছাই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল পৃথিবীর নানা জায়গায়। এ ধরনের বিশ্বাস বুকাওস্কির ছিল না। তিনি ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি এভাবে ভেবেছেন –‘বিশ্বাস জিনিসটা খারাপ না যাদের আছে, স্রেফ আমার ঘাড়ে তুলতে আসবেন না। কলের মিস্ত্রীকে ওই ভগবানের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি আমি। ওই মিস্ত্রীগুলো দারুণ ভালো কাজ করে। ন্যাড়গুলো যাতে ঠিকঠাক বয়ে যায় তার ব্যবস্থা করে’।
এরকম একটা মানুষ তাই আদি ভৌতিক, আদি দৈবিক কোনো টানেই ভারতে আসতে চাননি। বরং আস্থা রেখেছেন মদে। তার কাছে মদ ছিল এ পৃথিবীর সেরা আবিষ্কার। কারণ আমাদের সমাজে অনেকেই যারা ভুল সময়ে, ভুল জায়গায় আঁটকে গেছেন মদ তাদের সুইসাডের দিকে যেতে দেয়নি বরং আঁটকে রেখেছে। মদই সেই একমাত্র গান, নাচ যা তাঁদের জন্য পড়ে আছে এখনও। শেষ বাজার চালু সস্তা মিরাকেল।
বুকাওস্কি সম্পর্কে এটুকু একটা ধরতাই। প্রায় দু হাজার পাতার অপ্রকাশিত চিঠিপত্র থেকে বেছে যে বইটা বেরিয়েছে- ‘চার্লস বুকাওস্কি অন রাইটিং’, সেখান থেকে এই চিঠিটির অনুবাদ। চিঠিটি লেখা ১৯৮৩ সালে লস পেকুইনো গ্লাজিয়ার কে।
লস পেকুইনো গ্লাজিয়ার একজন কবি। ডিজিটাল পোয়েট্রি মুভমেন্টের একজন প্রধান প্রবক্তা। থাকেন নিউইয়র্কে।

এই চিঠিতে উল্লিখিত অন্যান্য লেখকদের সম্পর্কে দু এক লাইন জানিয়ে দেওয়া ভালো মনে হল আমার। যদিও আপনারা এদের অনেকের লেখাই পড়ে থাকবেন।



জন আপডাইক জন্মেছিলেন ১৯৩২ সালে। একজন আমেরিকান কবি, নভেলিস্ট, ছোটো গল্প লেখক এবং লিটারারি ক্রিটিক। তার খরগোশ সিরিজের জন্য তিনি বিখ্যাত। ২০০৯ সালে ৭৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
চেসলো  মিলোজ একজন পোলিশ কবি, গদ্যকার, অনুবাদক এবং ডিপ্লোম্যাট ছিলেন। ১৯৮০ তে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। তার নন ফিকশান ‘দা ক্যাপটিভ মাইণ্ড’ বিখ্যাত হয়েছিল বইটির স্টালিন বিরোধী চরিত্রর জন্য।
কবি, ঔপন্যাসিক স্টিফেন স্পেণ্ডার বিশ্বাস করতেন ক্লাস স্ট্রাগেলে। একজন ইংরেজ, যার লেখার বিষয় ছিল সামাজিক অসাম্য।
এডমাণ্ড হোয়াইট জন্মেছিলেন ১৯৪০-এ সিনসিনাতি তে। সমকাম ছিল প্রধানত তার লেখার বিষয়। মনে রাখতে হবে যখন তিনি গে-দের নিয়ে উপন্যাস লিখছিলেন তখন অন্য কেউ সে যন্ত্রণার কথা লেখেন নি। তাঁর আত্মজীবনী মূলক ট্রিলজি উপন্যাসের শেষ খণ্ড ‘দা ফেয়াওয়েল সিম্ফনি’ বিখ্যাত।
১৯৩৪ সালে লন্ডনে জন্মানো জোনাথান মিলার ছিলেন মূলত থিয়েটার আর অপেরা ডিরেক্টর। পরে পৃথিবী তাকে জানবে শুধু অপেরা ডিরেক্টর হিশেবে।
ডিক কাভেট আমেরিকান টেলিভিসানের একজন বিখ্যাত নাম তেমনই বিখ্যাত তার টক শো গুলো।
নরমান মেলার একজন আমেরিকান ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, অভিনেতা, রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট ইত্যাদি। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দা নেকেড অ্যান্ড দা ডেড’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ এ।
গোর ভাইডাল-এর জন্ম ১৯২৫ সালে। তিনি বিশ্বাস করতেন লেখার স্টাইল দিয়েই নিজেকে জানা যায়। কাউকে রেয়াৎ না করে নিজের কথা বলতে পারার উপায়।
ট্রুম্যান কাপোটি পপুলার কালচারের একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। ঔপন্যাসিক, ছোটো গল্পকার, নাট্যকার ইত্যাদি।
                                                                                                                                            
অ্যালেন গিন্সবার্গ বিট জেনারেশনের কবি যার নাম আমরা সবাই জানি। ‘হাউল’ সেই বিখ্যাত কবিতা যা লেখার জন্য তাকে অভিযুক্ত হতে হয়েছিল। সিটি লাইটস প্রকাশিত সেই বই আমেরিকাতে ব্যান হয়।
বার্ট রিনল্ডস হলেন একজন আমেরিকান অভিনেতা, ডিরেক্টর এবং প্রডিউসার।
এফ দস অর্থাৎ দস্ত্যেভস্কি, তুর্গেনেভ দুজনেই বিখ্যাত রাশান লেখক।
সিলিন একজন ফেঞ্চ লেখক।
হামসুন একজন নরওয়েজিয়ান লেখক। ১৯২০ সালে নোবেল পান।
জন ফান্টে একজন আমেরিকান লেখক। যার বই ‘আস্ক দা ডাস্ট’ বুকাওস্কির অনুরোধে আবার ছাপা হয়। যার মুখবন্ধ লিখেছিলেন বুকাওস্কি।
আমেরিকান শের উড অ্যান্ডারসন ছিলেন স্বশিক্ষিত। ঔপন্যাসিক এবং ছোটো গল্পকার।
কারসন ম্যাককুলার্স কবি, ঔপন্যাসিক।
জেফার্স একজন আমেরিকান কবি। 



এবার চিঠি  

লস পেকুইনো গ্লাজিয়ারের প্রতি
ফেব্রুয়ারি ১৬, ১৯৮৩

আমি জানিনা ব্যাপারটা ঘটে কীভাবে। মানে আমি বলতে চাইছি যে আমি এখন আগের থেকে অনেক বেশি ভালো লিখি না আদৌ, যা আমি লিখতাম বহু বছর আগে
যখন আমি অনাহারে মৃতপ্রায় ওই সব ছোট ছোট ঘরগুলোতে, পার্কের বেঞ্চে আর ধ্বসে পড়া বাড়িগুলোয়। আর ওই দমবন্ধ করা ফ্যাক্টরিগুলো আর ডাকঘরের বসেরা আমাকে প্রায় খুন করে ফেলেছিল। সেখানে যারা কাজ করে তাদের মানুষ হিশেবেই গণ্য করা হয়না। আসলে টিকে যেতে পারাই লেখালিখির মূল সূত্র। সেই সমস্ত সম্পাদক যারা দিনের পর দিন আমার লেখা রিজেক্ট করেছেন তারা অনেকেই আর বেঁচে নেই। মরে হেজে গেছে। কিছু নারীদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। আমার এখনকার লেখায় যদি তফাৎ কিছু থেকে থাকে তা হল এখন লেখা আমাকে আনন্দ দেয়, লিখতে মজা পাই আমি। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে খুব দ্রুত। একটা মুহূর্তে তুমি এক পেঁচো মাতাল লড়াই করে চলেছ আরেকটি মাতাল নেশাড়ী উন্মাদ রমণীর সাথে বস্তির একটা ঘরে তার পরেই তুমি ইয়োরোপের একটা হলে ঢুকছ যেখানে ২০০০ বুনো লোক তোমার কবিতা শোনার অপেক্ষায় বসে আছে। আর তোমার বয়স ৬০ বছর...

এখন ৬৩ হতে চলেছে আমার। এখন আর কবিতা পাঠ করতে যেতে হয়না মদ আর বাড়ি ভাড়ার টাকা জোটাতে। আমি যদি অভিনেতা হতে চাইতাম, পারতাম অভিনেতা হতে। লোকের সামনে নাচা কোঁদা করা আমার পন্থা নয়। কিছুদিন হল একজন ভদ্রলোক আমাকে লিখেছিলেন ---‘... কয়েকজন যারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন তারা হলেন জন আপডাইক, চেসলো  মিলোজ, স্টিফেন স্পেণ্ডার, এডমাণ্ড হোয়াইট, জোনাথান মিলার, ডিক কাভেট এবং ওয়েণ্ডেল বেরি। তাই বুঝতেই পারছেন আপনি খ্যাতির যোগ্য লোকজনের সাথেই আছেন...’
আমি তাঁকে না বলেছিলাম। যদিও সাম্মানিকের পরিমাণটা অনেকটাই ছিল।

এদের এরকম করতে হয় কেন?
আমি এটুকুই বলতে চাই যে এই মুহূর্তে এই ছোট শহর স্যান পেদ্রো তে থাকার মত যথেষ্ট পয়সা আমার থাকলেই অনেক। যেখানে লোকজন স্বাভাবিক আর সহজ আর বোকা আর ভালো আর একজন লেখক বা একজন পেইন্টারকে আশপাশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এখানেই আমি থাকতে পারি আমার তিনটে বেড়াল নিয়ে আর প্রতিরাতে মদ খেতে পারি আর টাইপ করতে পারি রাত ২টো, ৩টে অবধি। আর পরের দিন
আছে রেসের মাঠ। আমি এটুকুই চাই। আর ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট ঠিক তোমায়(আমায়) খুঁজে নেবে। এখনও ভালো আর খারাপ মুহূর্ত গুলো আছে নারীদের সাথে। কিন্তু আমার এই সেট আপ পছন্দের। ভাগ্যিস আমি নরমান মেলার বা কাপোটি বা ভাইডাল নই। বা দা ক্ল্যাসের সাথে কবিতা পড়া গিন্সবার্গ নই, আমি সুখী যে আমি দা ক্ল্যাস-ও নই।
আমি এটাই বলতে চাইছি যে যখন ভাগ্য তোমার সহায় হয় তখন সেই ভাগ্য যেন তোমায় গিলে না খায়। তোমার বয়স যদি বিশের কোঠায় হয় আর তখন যদি তুমি বিখ্যাত হও, সেটা তখন কাটানো খুব কঠিন কাজ। আর ৬০ বছর পার করে তুমি যদি খানিকটা বিখ্যাত হও তখন তা নিয়ন্ত্রণ করাটা সোজা। বুড়ো এজরা পাউণ্ড বলতেন –‘নিজের কাজটা কর’। আর আমি ঠিক বুঝতাম আসলে তিনি কী বলতে চাইছেন। যদিও আমার কাছে লেখালিখিটা কখনও কাজ ছিলনা অন্তত মদ খাওয়ার থেকে বেশি কাজ তো নয়ই। আর অবধারিত ভাবে এখন আমি মদ খাচ্ছি আর এ চিঠিটা যদি একটু তালগোল পাকিয়ে যায়, পাকাকগে ওটাই আমার স্টাইল।

কবিদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। কয়েকজন তো শুরু করে দারুণ। লেখার ভেতর একটা বিদ্যুৎ চমক, একটা জ্বালা, একটা ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা টের পাবেন। খুব ভালো একটা প্রথম বা একটা দ্বিতীয় বই, তারপর তারা কেমন জোলো হয়ে ওঠে। চারিদিকে দেখুন দেখবেন তারা ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর ক্লাস নিচ্ছে কোনো একটা ইউনিভার্সিটিতে। তার মানে তারা জানে কীভাবে লিখতে টিখতে হয় আর তা তারা অন্যদের সে সব বলবেও। এটাতো একটা রোগ, তারা নিজেদের মেনে নিয়েছে। এটা যে তারা করতে পারছে বিশ্বাসই করা যায় না। এটা এরকম যে একজন এসে আমাকে বলছে কীভাবে চুদতে হয় কারণ সে মনে করে সে অসাধারণ চোদে।

যদি সত্যি কোনো ভালো লেখক থাকে আমি মনে করি না তারা ঘুরে বেড়ায়, হেঁটে বেড়ায়, বকে বেড়ায় এটা ভেবে যে তারা লেখক, তারা বেঁচে থাকে আর কিছুই করার নেই বলে। ক্রমাগত বেড়ে চলে আতঙ্ক আর আতঙ্ক নয় যা আর সব বক বক, গাড়ির ফেটে যাওয়া টায়ার আর দুঃস্বপ্ন, আর্ত চিৎকার, হাসি আর মৃত্যু আর জিরোর লম্বা খালি জায়গাটা আরও ওইসব, সব কিছু জট পাকায় এক সাথে তারপর তারা দেখতে পায় টাইপ মেশিন আর বসে গিয়ে তাতে আর ঠেলে বেরিয়ে আসে সব, কোনো প্ল্যান ছাড়াই, ওটা ঘটে, যদি তাদের ভাগ্য তখনও তাদের সহায় হয়।

এখানে কোনো নিয়ম নেই। আমি আর অন্য লেখকদের লেখা পড়তে পারিনা। আমি একাকী। কিন্তু আমি অন্যদের থেকে ধার করি আমার শূন্য স্পেসের জন্য। আমি ভালোবাসি একটা ভালো প্রফেশানাল ফুটবল ম্যাচ দেখতে বা একটা বক্সিং ম্যাচ অথবা ঘোড় দৌড় যেখানে সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীই প্রায় সমান। আমার ভালো লাগে এইসব দেখতে যা কিছুটা চরিত্রর দৃঢ়তা ধার দেয়।
এই খেলা শেষ করতে মদও সাহায্য করে খুব। যদিও অনেককেই আমি এই সাহায্য নিতে বলব না। বেশির ভাগ মাতালই খুব একটা কৌতূহল-উদ্দীপক নয়। যদিও মদ না খাওয়া লোকজনও যে খুব কিছু কৌতূহল-উদ্দীপক হয় তাও নয় আরকি।

ড্রাগ নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় আমি ড্রাগ নিয়েছি। কিন্তু সেটা ছেড়েও দিয়েছি আবার। গাঁজা প্রেষণা প্রণোদনা নষ্ট করে আর সবসময় তোমার দেরি হয়ে যায় যদিও কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তোমার। কোক ছাড়া বাকি অতি-ড্রাগ গুলো তোমায় কোথাও নিয়ে যায় না এমনকি তুমি যে আছো সে কথাই ভুলিয়ে দেয়। আমি অবশ্য মোদো, যাতে তুমি টিকবে বেশি দিন, বেশি টাইপ করবে... জুটবে কতনা নারী সঙ্গ, আরো অনেকবার ঢুকবে হাজতেও...

আর অন্য বিষয় হল, হ্যাঁ আমি ফ্যানেদের চিঠি পাই, খুব বেশি নয়, সপ্তাহে ৭টা ৮টা চিঠি, ভাগ্যিস আমি বার্ট রিনল্ডস নই। আমি সবকটার উত্তর দিতে পারি না যদিও কখনো সখন দি, যদি তা কোনো পাগলখানা বা জেলখানা থেকে আসে যেমন একবার বেশ্যালয়ের এক মাসীর থেকে একটা চিঠি এসেছিল। আমার ভালো লাগে ভাবতে যে ওইসব লোক আমার লেখা পড়েছে। সেই একই কথা জানতে চেয়ে আমি অনেক চিঠি পাই –‘আপনি যদি বিখ্যাত হয়ে থাকেন তবে তো আমাদেরও একটা সুজোগ আছে’। অন্যভাবে বলতে গেলে ওরা জানে যে আমাকে কী অত্যাচারটাই না সহ্য করতে হয়েছে। তবু আমি টিকে আছি। আমার তাতে অসুবিধে নেই যদি এটা ভেবে ওরা শান্তি পায় যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা ছ বোতল বিয়ার নিয়ে এসে আমার দরজায় কড়া নাড়ছে তাদের দুঃখের কাহিনী শোনানোর জন্য। আমি এখানে মানুষকে উদ্ধার করত বসে নেই। আমি নিজের ভিতু গাঁড় বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে আছি মাত্র। মদ খেতে খেতে টাইপ করে চলেছি শব্দগুলো যা আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে। বোঝা গেল ব্যাপারটা?
আমি অতটাও একা নই। আমারও ক্রাচ আছে। এফ দস, তুর্গেনেভ, সিলিনের কিছুটা, কিছুটা হামসুনের, জন ফান্টের বেশিরভাগটাই, শের উড অ্যান্ডারসনের অনেকটাই, হেমিংওয়ের প্রথম দিকের লেখা, কারসন ম্যাককুলার্সের সবটুকু, জেফার্সের লম্বা কবিতা গুলো, নিৎসে আর শোপেনহাওয়ার, সারোয়ানের স্টাইল কন্টেন্ট বাদ দিয়ে, মোৎজার্ট, মাহলের, বাখ, ওয়াগ্নার, এরিক কোটস, মন্রিয়ান, ই ই কামিংস আর পূর্ব হলিউডের বেশ্যারা, জ্যাক নিকলসন, জ্যাকি গ্লিসন, চার্লি চ্যাপলিনের প্রথম দিকটা, ব্যারন ম্যানফ্রেড ভন রিচথোফেন, লেস্লি হাওয়ার্ড, বেটি ডেভিস, ম্যাক্স স্কেমেলিং, হিটলার, ডি এইচ লরেন্স, হাক্সলি আর ফিলির লালমুখো ওই বুড়ো বারটেণ্ডার...আর একজন অভিনেত্রী যার নামটা মনে পড়ছে না, যাকে আমার আমাদের সময়ের সেরা সুন্দরী বলে আমি মনে করি। সে মাল খেয়ে খেয়ে মরে গেছিল ...

আমিও কখনো রোমান্টিক হয়ে পড়ি। আমি একটি মেয়েকে জানতাম, ভালোই দেখতে ছিল সেই পাঊণ্ডের বান্ধবী ছিল। ক্যান্টোসের কিছু অংশে উল্লেখ আছে তার। তারপর সে গেল জেফার্সের সঙ্গে দেখা করতে। সে কড়া নাড়ল তার দরজায়। হয়ত সে চেয়েছিল পৃথিবীর একমাত্র নারী হতে যে পাঊণ্ড আর জেফার্স এই দুজনের সাথেই শুয়েছে। জেফার্স দরজা খোলেনি। একজন বুড়ি ভদ্রমহিলা খুলেছিলেন। এক মাসী, বাড়ির দেখাশোনা করতেন সম্ভবত। তো সেই সুন্দরী, বুড়ি কে বলল  -                            ‘আমি বাড়ির মনিবের সাথে দেখা করতে চাই’। ‘একটু দাড়ান’ – উত্তরে বললেন সেই বয়স্কা মহিলা। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলেছিলেন –‘জেফার্স বলেছেন যে তিনি তার পাহাড় তৈরি করেছেন, যান গিয়ে আপনারটা বানান’...
আমার এই গল্পটা ভালো লেগেছিল। কারণ সে সময় সুন্দরীদের নিয়ে আমার ঝামেলার শেষ ছিল না। কিন্তু এখন যখন ভাবি তখন মনে হয় সেই বুড়ি হুয়তো কোনো কথাই বলেনি জেফার্সের সাথে। কিছুক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে ফিরে এসে সুন্দরীকে এসব কথা বলেছিল। যাইহোক আমিও পাইনি তাকে কিন্তু আমি এখনও নিজের পাহাড় তৈরি করতে পারিনি যদিও অনেক সময় যখন কিছুই থাকে না চারিদিকে তখন দেখি পাহাড়টা আছে।
আমি একথাই বলতে চাইছি যে কেউই আসলে বিখ্যাত হয় না অথবা ভালো। ওটা গতকালের ঘটনা। হয়ত তুমি বিখ্যাত আর ভালো হতে পারো মৃত্যুর পর। কিন্তু তুমি যতক্ষণ বেঁচে আছো যা হতে পারে তা হল এই ঝামেলার ভেতর খানিক্কটা ম্যাজিক দেখানো। সেটাকে হতে হবে আজকের অথবা আগামী কালের। যা তুমি করে ফেলেছ তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়েনা। এটা নিয়ম নয় এটাই বাস্তবতা। এটাই বাস্তবতা যখন ডাকে পাওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর তুমি দিতে পার না। কারণ তাহলে তোমাকে ক্রিয়েটিভ রাইটিং–এর কোর্স পড়াতে হত।
আমি বুঝতে পারছি চড়ে যাচ্ছে আমার, কিন্তু একটা খারাপ কবিতায় এটা তো ঘটতেই পারে, যা তুমি পাবে। আমার সব সময় মনে পড়ে ক্যানিয়ন রিভিউ আর সিওয়ানি রিভিউয়ের ক্রিটিকাল লেখাগুলোর কথা সেই পুরোনো পার্কের বেঞ্ছে বসে থাকার দিনগুলো আর তাদের ভাষার ব্যবহার আমার ভালো লাগত যদিও আমার মনে হত ওগুলো আসলে সব মিথ্যে কথা।
বার্টেণ্ডার? আমরা কী করব? খুব বেশি কিছু নয়। হয়ত ভাগ্য ফেরাব। ওটুকুই দরকার আর এন্টারটেইনমেন্টের অল্পস্বল্প বোধ, সে মুহূর্তের আগে যখন ওরা আমাদের ঘরের এক কোণায় দেখবে আমরা শক্ত হয়ে গেছি, অব্যবহার্য, যারা তখনো টিকে আছে তাদের কাছে। আমার খুব দুঃখ হয় এটা ভাবতে যে আমরা এতটাই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তুমি ঠিক, কী আর আছে তুলনা করার মত? ওটা কোন সাহায্য করে না। চল মদ খাই। আবারো খাই খানিকটা ... একটা ছোট্ট টিনের ফর্ক দিয়ে এইসব নোংরামি কেটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টায়...

বুকাওস্কি নিজেই লিখেছেন প্রতিদিন তিনি কম করে পাঁচ ছটা কবিতা লিখতেন। আর ভাগ্য সদয় হলে অনেক বেশি। মানে বছরে প্রায় হাজার দেড়েক কবিতা বা তারো বেশি। এই চিঠি যখন তিনি লিখছেন তাঁর ২০০ পাতার বই ‘হট ওয়াটার মিউজিক’ প্রকাশিত হয়েছে ব্ল্যাক স্প্যারো প্রেস থেকে। পরের লাইনগুলো সে বই থেকেই...
উকিল, দাক্তার, কলের মিস্ত্রী
সবাই টাকা করেছিল।
লেখকেরা?  
লেখকেরা উপোষ করেছে।
লেখকেরা আত্মহত্যা করেছে।
লেখকেরা পাগল হয়ে গেছে।