এক হারামি বুড়োর
নোটস
১
চার্লস বুকাওস্কি
অনুবাদ - শুভঙ্কর দাশ
কোনো এক খানকির
ছেলে টাকা পয়সা চেপে রেখেছে, সবাই দাবী করছে তারা ঠনঠন গোপাল। তাস খেলা শেষ হয়ে গেছে,
আমি বসে ছিলাম আমার বন্ধু এলফের সাথে, ছোটো-বেলা থেকেই এলফের গাঁড় মারা গেছিল, কঁচকে-মুচকে
গেছে একেবারে, বছরের পর বছর ও বিছানায় পড়ে থেকেছে আর টিপেছে ওই রবারের বলগুলো, আর কীসব
পাগলা-বেয়াম করেছে আর যখন সে একদিন বিছানা ছেড়ে উঠল সে তখন যতটা লম্বা ততটাই চওড়া হয়েছে,
এক পেশী বহুল হাসিমুখ বর্বর, যে লেখক হতে চায় কিন্তু ও বড় বেশি থমাস উলফের মতো লেখে
আর ড্রেইসার ছাড়া থমাস উলফের মতো খারাপ আমেরিকান লেখক আর জন্মায় নি, আর আমি এলফের কানের
পেছনে মারলাম এক ঘুঁষি আর টেবিল থেকে বোতলটা পড়ে গেল (ও কিছু একটা বলেছিল যেটা আমার
পছন্দ হয়নি) আর যখন এলফ এগিয়ে এলো আমার কাছে ছিল বোতলটা, ভালো স্কচ, আমি আবার মারলাম ঘুঁষি যা গিয়ে লাগল কিছুটা
ওর থুতনি আর কিছুটা গলায় আর ও পড়ে গেল ফের, আর এ খেলাটায় নিজেকে বেশ বীর মনে হচ্ছিল,
আমি দস্ত্যেভস্কির ছাত্র আর অন্ধকারে মাহলের শুনি, আর আমি বোতল থেকে খানিকটা মাল গলায়
ঢালার সময় পেলাম, তারপর ওটা নামিয়ে রেখে ডান হাতের মুঠো তুলে মারার একটা চুক্কি দিয়ে
চালালাম বাঁহাত ওর বেল্টের নীচ বরাবর আর ও পড়ল গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থপ করে, আয়নাটা
ভেঙ্গে গেল, একটা সিনেমার দৃশ্যের মতো আওয়াজ তুলে, একটা ঝলকানি আর
একটা ঝলকানি আর ঝনঝন আর তারপর এলফ আমার কপালে মারল এক ঘুঁষি আর আমি পড়লাম গিয়ে
একটা চেয়ারের উপর আর ওটা দুমড়ে গেল খড়ের মতো, সস্তার ফার্নিচার সব, আর তারপর আমি গভীর
ঝামেলায় জড়ালাম _ আমার হাতগুলো ছোটো আর সেভাবে মারামারির সত্যিকারের অভিজ্ঞতা নেই আর
আমি ওকে মেরে বসিয়ে দিতে পারিনি - আর ও এলো যেন এক সস্তার ভাঁড়ের মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ
হয়ে, আর আমি একটা ঘুঁষির বদলে খাচ্ছিলাম তিনটে যদিও সেগুলো তেমন কিছু নয়, কিন্তু সে
নাছড় আর ফার্নিচারগুলো ভাঙ্গছিল ঘরের সব দিকে, খুব আওয়াজ হচ্ছিল আর আমি ভাবছিলাম কেউ
একটা এসে থামাবে এটা – বাড়িউলি, পুলি্স, ভগবান, যেকেউ, কিন্তু ওটা চলতেই থাকল, চলতেই
থাকল আর তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।
যখন ঘুম ভাঙ্গল
আমার তখন সূর্য উঠে গেছে আর আমি খাটের তলায়। আমি খাটের তলা থেকে বেরিয়ে দেখলাম আমি
উঠে দাঁড়াতে পারছি। থুতনির তলায় একটা বড় কাটা দাগ। আঙুলের গাঁটগুলো ঘষড়ে গেছে। এর থেকেও
খারাপ হ্যাঙ্গওভার আমার হয়েছে। আর আরো খারাপ জায়গায় ঘুম ভেঙ্গেছে আমার। যেমন জেলখানায়?
হয়ত। আমি তাকালাম চারপাশটায়। ব্যাপারটা সত্যি ঘটেছে। সবকিছু ভাঙ্গা আর চেপ্টে আছে চূর্ণবিচূর্ণ,
গড়াগড়ি খাচ্ছে সবকিছু – টেবিল ল্যাম্প, চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল, বিছানা, ছাইদান – একটা
মাত্রাছাড়া অবস্থা, কিছুই বোধগম্য ঠেকছে না, সবকিছুই মনে হচ্ছে কুৎসিত আর খতম। আমি
খানিকটা জল খেলাম আর তারপর এগিয়ে গেলাম আলমারিটার দিকে যেটা তখনও টিকে ছিল। দশ, বিশ,
পাঁচের টাকাগুলো যেগুলো আমি ভেতরে ছুঁড়েছি যতবার আমি তাস খেলার সময় উঠেছি মুততে, আর
আমার মনে পড়ে গেল এই টাকা নিয়েই ঝাড়পিটের শুরু।
আমি টাকাগুলো জড়ো করে মানি ব্যাগে রাখলাম, আমার কাগজের সুটকেস রাখলাম বেঁকে যাওয়া খাটের
উপর আর তারপর আমার সামান্য ছেঁড়া জামাকাপড় ভরতে লাগলাম সেটায়, শ্রমিকের জামা, তলায়
ফুট হওয়া শক্ত জুতো, নোংরা মড়মড়ে লম্বা মোজা, ঢোলকা পাতলুন যার পাগুলো হাসতে চাইছে,
আর সানফ্রানসিসকো অপেরা হাউসে কাঁকড়া ধরা নিয়ে একটা ছোটো গল্প আর একটা ছেঁড়া মিতব্যয়ী
ওষূধের দোকানের অভিধান - ‘উজ্জীবন – সংক্ষেপে
পূর্বপুরুষদের ইতিহাস আবার ঝালিয়ে নেওয়া’।
ঘড়িটা কাজ করছে,
পুরনো অ্যালার্মঘড়ি, ভগবান ওকে আশীর্বাদ করুন, কতবার যে আমি ওর দিকে তাকিয়েছি সকাল
৭-৩০এ। হ্যাংওভারের সকালে আর বলেছি চাকরির গাঁড়ে? চাকরির গাঁড় মারা যাক। বেশ এটা এখন
বলছে বিকেল ৪-৩০। সবে ওটা আমি সুটকেসের উপর দিকে রাখতে গেছি তখন – কেনই বা তখন নয়?
আবার দরজায় কেউ ঠকঠক করে উঠল।
হ্যাঁ?
মিঃ বুকাওস্কি?
হ্যাঁ? হ্যাঁ?
আমি ভেতরে এসে
বিছানার চাদরটা পালটাতে চাই।
না, আজ নয়। আজ
আমি অসুস্থ।
আহা, সেতো খুবই
খারাপ ব্যাপার তবু আমাকে ভিতরে গিয়ে বিছানার চাদরটা পালটে দিতে দিন। তারপর আমি চলে
যাব।
না, না সত্যিই
আমি খুব অসুস্থ। খুবই অসুস্থ। আমি চাই না এ অবস্থায় আপনি আমাকে দেখুন।
তো ব্যাপারটা
চলতেই থাকল এভাবে। উনি চাদরটা পালটাতে চাইছেন। আমি বলছি, না। উনি বলছেন আমি বিছানার
চাদরটা পালটাতে চাই। বারবার সমানে। ওই বাড়িউলির কী দারুণ চেহারা। পুরোটা শরীর শুধু।
তার সবটাই যেন চেঁচিয়ে বলছে শরীর শরীর শরীর। আমি এখানে আছি মাত্র সপ্তা ২। বাড়ির নীচেই
একটা বার। লোকে আমার সাথে দেখা করতে আসত, আমি হয়ত ঘরে নেই। উনি বলতেন, ‘উনি নীচের বারে
আছেন। উনি সারাক্ষণই নীচের বারেই থাকেন।‘ আর
লোকজন বলত, হে ভগবান, কে গো এই বাড়িউলি?’
তিনি ছিলেন সাদা
চামড়ার বড়সড় এক নারী যিনি পছন্দ করতেন ফিলিপিনোদের। আর এই ফিলিপিনোরা অনেক কায়দা জানত,
যা একজন সাদা চামড়ার পুরুষ ভাবতেই পারবে না, এমনকী আমিও, আর এখন ওরা সব চলে গেছে ওদের
জর্জ র্যাফট মার্কা গ্যাংস্টার টুপির প্রান্ত আর জামায় প্যাড দিয়ে চওড়া করা কাঁধ,
ওরা ছিল ফ্যাসান লিডার একসময়, চাকু ছোকরারা, লেদারের হিল, তেলচিটে বদ মুখগুলো – কোথায়
গেলে সব?
যাক, বলার এই
যে আমার কাছে গলা ভেজাবার কিছুই নেই আর আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে পাগ্লে যাচ্ছিলাম,
ছটফট করছিলাম, আমি সত্যি একেবারে ডাঁশ-মশার মতো বিচি ফুলিয়ে বসে আছি ৪৫০ ডলার হাতে
নিয়ে যা তাস পিটিয়ে কামিয়েছিলাম আর আমি একটা ড্রাফট বিয়ারও কিনতে পারছি না। আমি অন্ধকারের
অপেক্ষায় ছিলাম। অন্ধকার, মৃত্যু নয়। আমি পালাতে চাই। আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।
অবশেষে নিজেকে সামলে অল্প খুললাম দরজাটা, দরজার চেনটা লাগানো আছে তখনো, দেখি একটা বেঁটকে
ফিলিপিনো বাঁদর হাতুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার গোড়ায়। যেই দরজাটা খুলেছি সে হাতুড়িটা
তুলল মুচকি হেসে। যখন আমি দরজাটা বন্ধ করলাম সে মুখ থেকে পেরেক বার করে সিঁড়ির কার্পেটে
ঠোকার ভান করতে লাগল, যা দোতলার দিকে উঠেছে আর ওখানেই বেরোবার একমাত্র দরজা। আমি জানি
না এটা কতক্ষণ ধরে চলেছিল। একই ব্যাপার ঘটছিল বারে বারে। যতবার আমি দরজা খুলেছি সে
মুচকি হেসে হাতুড়ি তুলছিল। গান্ডু বাঁদরটা ঠিক এক ধাপ উপরের সিঁড়িতে বসেছিল। আমি পাগল
হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি ঘামছিলাম, গা দিয়ে বোঁটকা গন্ধ ছাড়ছিল, চক্রাকারে পাক মারছিলাম,
আমার এধারে মাথার ভেতর আলোর ঝলকানি। আমি সত্যি সত্যি অনুভব করলাম আমি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি।
আমি এগিয়ে সুটকেসটা নিলাম। নিতে অসুবিধে নেই। ছেঁড়া কানি স্রেফ। তারপর নিলাম টাইরাইটারটা।
স্টিলের তৈরি পোর্টেবেল একটা জিনিস যা আমি ধার করেছিলাম এক সময়ের বন্ধুর বউয়ের কাছ
থেকে যা আর ফেরত দিই নি আমি। শক্ত স্টিলের একটা ভাব ছিল সেটায়। ধূসর, সমতাল, ভারী,
সজাগ, গতানুগতিক। আমার চোখ দুটো পাক খেয়ে চলে গেল মাথার পিছন দিকে আর দরজা থেকে চেনটা
খুলে আমি দ্রুত বাইরে এলাম একেবারে প্রস্তুত, এক হাতে সুটকেস অন্য হাতে ঝেড়ে দেওয়া
টাইপ্রাইটারটা, শোক শোক শোকের সূর্যদয়, ফেটে যাওয়া গমের মোচড়, সব কিছুর শেষ।
এই যে! কোথায়
চলেছেন?
বেঁটকে বাঁদরটা
এক হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে, হাতুড়িটা তুলল, আর জাস্ট এটুকুই আমার প্রয়োজন ছিল – হাতুড়ির
উপর বৈদ্যুতিক আলোর একটা ঝলকানি – আমার বাঁ হাতে ছিল সুটকেসটা, স্টিলের পোর্টেবেল টাইপরাইটারটা
ডান হাতে, ও ছিল একেবারে সঠিক অবস্থানে, ঠিক আমার হাঁটুর নীচ বরাবর আর আমি ঘুরিয়ে টাইপরাইটারটার
শক্ত দিকটা দিয়ে মারলাম ঠিকঠাক তার মাথার পাশ বরাবর ওর রগে, খুলিতে এক ঘা।
একটা আলোর তরঙ্গ
খেলে গেল যেন সবকিছু কেঁদে উঠল এক সাথে তারপর সব চুপ স্থির। আমি বাইরে, হঠাতই, পাশের
গলিতে, অতগুলো সিঁড়ি কীভাবে নেমে এলাম জানি না। ভাগ্য বলতে হবে, দেখি একটা হলুদ ট্যাক্সি।
ট্যাক্সি।
আমি ট্যাক্সির
ভেতর। ইউনিয়ান ষ্টেশন।
ভালোই বেশ, টায়ারের
শান্ত শব্দ সকালের বাতাসে।
না, দাঁড়ান, আমি
বললাম। বাস ডিপোতে নিয়ে চলুন বরং।
কী ব্যাপার দাদা?
ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল।
আমি এইমাত্র আমার
বাবাকে খুন করেছি।
আপনি আপনার বাবাকে
খুন করেছেন?
কখনো যীশু ক্রিস্টের
নাম শুনেছেন?
নিশ্চয়ই।
তাহলে বাস ডিপোতে
চলুন।
আমি বাস ডিপোতে
এক ঘন্টা অপেক্ষায় বসে আছি নিউ অরলিয়ন্সের বাসের জন্য। আর মনে মনে ভাবছি লোকটাকে কি
মেরে ফেললাম আমি? অবশেষে বাসে উঠলাম টাইপরাইটার আর সুটকেস নিয়ে, মাথার উপরের তাকে টাইপরাইটারটাকে
গুঁজে রাখলাম একটু দূরে, যাতে ওটা মাথার উপর না এসে পড়ে। বাসযাত্রাটা ছিল বেশ লম্বা
আর মদ খাওয়া আর ফোর্ট ওয়ার্থের এক লাল চুলো মেয়ের সাথে অল্প ফষ্টিনষ্টি। আমিও নেমে
গেছিলাম ফোর্ট ওয়ার্থে কিন্তু মেয়েটি থাকে তার মায়ের সাথে আর তাই আমাকে একটা ঘর ভাড়া
নিতে হবে, আর ভুল করে আমি একটা ঘর নিয়ে ফেললাম একটা বেশ্যাখানায়। সারা রাত ধরে মেয়েগুলো
চেল্লাচ্ছিল, যেমন নাকি ‘এইযে, কোনো অবস্থাতেই ওইটা তুমি আমার ভেতর ঢোকাবে না, যতই
টাকা দেখাও না কেন!’ সারাত ধরে টয়লেটের ফ্লাস চলছে। দরজা খুলছে বন্ধ হচ্ছে।
ওই লাল চুলো মেয়েটা,
বড় ভালো নিষ্পাপ বেচারি বা আরো একটা ভালো মানুষের জন্য দর করেছে। সে যাইহোক, আমি তার
প্যান্টের নীচে না ঢুকেই শহর ছাড়লাম। অবশেষে গিয়ে পৌঁছলাম নিউ অরলিয়ন্সে।
কিন্তু সেই এলফ।
মনে আছে তো? যার সাথে আমি মারপিট করেছিলাম আমার ঘরে। তা সে যুদ্ধের সময় মারা গেছিল
মেশিনগানের গুলিতে। আমি শুনেছি সে বিছানায় পড়েছিল বহুদিন, ৩ বা ৪ সপ্তাহ হবে তারপর
মারা গেছিল। আর সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ও আমাকে বলেছিল, না, আমাকে জিজ্ঞাসা
করেছিল ‘যদি কোনো খানকির ছেলে মেশিনগানের ট্রিগারে আঙুল দিয়ে আমাকে দু আধখানা করে দেয়?’
‘সেটা হবে তোমার
দোষ।‘
‘বেশ আমি জানি
তুমি কখনোই কোনো বালের মেশিনগানের গুলিতে মরবে না।‘
‘তুমি শালা একেবারে
নিশ্চিত তাই না? আমি নই সোনা। যদি না তা শ্যাম কাকার হয়।‘
‘ওসব বালের কথা
আমায় বোলো না, আমি জানি তুমি তোমার দেশকে ভালোবাসো। আমি তোমার চোখের ভেতর সেটা দেখতে
পাই। ভালোবাসা, সত্যিকারের ভালোবাসা।‘
আমি প্রথ্মবার
এর পরেই ওকে মেরেছিলাম।
তারপর গল্পের
বাকিটা আপনারা জানেন।
নিউ অরলিয়ন্সে
পৌঁছে এটা দেখে নিয়েছিলাম যেন কোনো বেশ্যাখানায় আবার না গিয়ে উঠি, যদিও পুরো শহরটাই
সেরকমই দেখতে।