Wednesday, June 10, 2020

দশ বছর আগের দুটো দিন এবং






















গ্যাব্রিয়েল্লা

ধরা যাক তার নাম ছিল গ্যাব্রিয়েল্লা
যার গাড়ির ড্যাসবোর্ডে আমি
চক দিয়ে লিখেছিলাম একটা
কবিতার লাইন।
তা কি ছিল সমুদ্রের ঢেউ গোনার কথা
নাকি ঢেউয়ের নাম গোত্রের ইতিহাস?
এতদিন পর আর মনে পড়ছে না।
স্মৃতিগুলো ধোঁয়া হয়ে পুরোটা জানালা দিয়ে
বেরিয়ে যাওয়ার আগেই ভাবলাম ধরে রাখি
কয়েকটা মুহূর্ত।
কীভাবে যে ১০টা বছর চলে গেল।
সেই আমাকে বসিয়েছিল তার পাশে
আর তার হাতে ছিল স্টিয়ারিং।
পেছনের সিটে আমার বন্ধু
যার সাথে কথা চলছিল তার।
তারপর তর্ক জমে উঠল এতটাই
যে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে
চলল সেই শব্দের ঝড়,
যার এক বর্ণও আমি বুঝতে পারছিলাম না।
এদিকে রাস্তায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে গাড়ি
আর তাদের হর্ন বাজছে সমানে।
মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাদের
বাসতার্ডো বলে আবার ঝড়ের শুরু হচ্ছে।
আমি একে অতিথি তায় ভেতো বাঙালি
আস্তে আস্তে বললাম
গাড়িটা সাইড করে নিলে হয় না?
সে অবাক চোখে একবার আমাকে দেখে
গাড়ি স্টার্ট দিলো ফের।
এত কথা কোথায় যে থাকে মানুষের কে জানে?
যেন মেশিনগান চলছে
মনে মনে ভাবছিলাম আমি।
কফি খেতে যাওয়া তখন মাথায় উঠেছে।




ড্যানিয়েল্লা

আমি একটুও ভেগান নই
সপ্তাহে কদিন পেটে একটু ঝুনো দিলেও
আমার দাঁতে কাটার রসদ চাই।
অভাবে চিকেন খেয়ে দেখেছি
ভালো লাগে না
বড় একঘেয়ে লাগে।
এসবই জানত আমার ইতালিয়ান বন্ধুটি।
তাই সে আমাকে ঘোড়ার মাংসের স্টেক খাওয়ায়।
ওই প্রথম খাওয়াতেই প্রেমের ঘোর
যা আজও কাটেনি আমার।
দ্বিতীয় দিন আমিই প্রস্তাব দি
এবং সেদিন আমাদের সংগে
সাথ দিয়েছিল সেই সুন্দরী
ড্যানিয়েল্লা
যাকে দেখলেই প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে।
কিন্তু ভাষা দাঁড়াল দেওয়াল তুলে।
সে ইংরেজি জানে না
আমিও ইতালিয়ান জানি না।
কত আর চোখে চোখে কথা বলা যায়,
তার চেয়ে বরং মন দি মাংসে
ছোটো ছোটো বান রুটি গরম করে দেওয়া
যা ঠাণ্ডা হলেই শক্ত হয়ে যায়
তার সাথে গলা ভেজাতে
এক জাগ রেড ওয়াইনে।
ওফ্ফ সে স্বর্গলাভের কথা বোঝানো যাবে না
যেভাবে আমার সাথে ড্যানিয়েল্লার প্রেমের কথাও।
ওই রাস্তার বেতের চেয়ারগুলো জানে
ওই টেবিলের তলার অন্ধকারও
হয়ত জানে কিছুটা
সেই অবশ অসহায়তার কথা।




হে বন্ধু আমার

তোমার কথা মনে পড়ছে
হে বন্ধু আমার
তুমি কি এখনো
বেঁচে বর্তে আছো মিলানে?
রোজ বাসন মাজার সময় আরো বেশি করে
মনে পড়ে তোমায়।
তোমার মতো
কাগজের প্লেটে খাওয়ার প্র্যাক্টিস করা ভালো।
খেয়েদেয়ে প্লেট ফেলে দাও স্রেফ
ক্রমাগত বেশিনে জমাবার দরকার নেই,
জমে থাকা জলে ডুবো পাহাড়ের মতো।
বাঁধা কপি কিনে এনে ঘচাঘচ কেটে
অল্প নুন আর মরিচ আর স্যালাড অয়েল মেরে
কাঁটা চামচ দিয়ে খেয়ে নাও যদি
নিজেকে খুব গরু গরু লাগবে কি?
আমার লাগে নি যদিও।
সাথে রেড ওয়াইনের তাগড়াই বোতল খানা
ছিল সাথ দেওয়ার জন্য বলেই কি?
ইতালির ঠাণ্ডায় বেশ একটা আরাম
ঘনিয়ে আসছিল শরীরে।
তুমি কি এখনো
বেঁচে বর্তে আছো মিলানে?
নাকি মারা গেলে
কিছু না বলেই?




Friday, February 28, 2020

স্মৃতির কয়েকটা পাতা






যে বাড়িতে আমি বড় হয়েছি সেটা মুদিয়ালির একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির নাম ফলকে লেখা ছিল সত্য কুঠির। আমার ঠাকুর্দা বাড়িটি বানিয়েছিলেন আমার ঠাকুমার জন্য প্রায় একশ বছর আগে। ইচ্ছে ছিল একটা স্কুল বানাবেন। সে জন্য বাড়িটার অজস্র জানালা দরোজা ছিল। কিন্তু তাঁর দুই ছেলে শেষমেশ এসে উঠল এ বাড়িতেই। গ্রামে আর তাদের মন টেকেনি। জমিদারীর জায়গা জমি বেচেবুচে তাঁরা শহরে এসে পড়লেন। আমার বাবার গায়ে শহরের হাওয়া আগেই লেগেছিল অবশ্য। স্কটিসচার্চে তাঁর পড়াশোনার সুবাদে। এই জায়গাটা টিপুসুলতানের নায়েবের জায়গা ছিল। রাস্তাটার নাম টিপুসুলতান রোড। যেখানে এখন দেশপ্রাণ স্কুল সেই পুরো জায়গাটাতেই নায়েবের বসত বাড়ি ছিল। পেছনে নিজস্ব মসজিদ যার অস্তিত্ব এখনো আছে, মুদিয়ালি মাংসের দোকানের ঠিক পেছনটায় সেটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে পুরনো সব স্মৃতি নিয়ে।  
এলাকায় আমাদের বাড়ি ভূতিয়া বাড়ি হিসেবে বিখ্যাত কেন, এ কথায় বাবা-মার থেকে কোনো সঠিক উত্তর পাইনি কোনো দিন। পরে ঠাকুমার মুখে জেনেছিলাম টিপুসুলতানের নায়েবের নিজস্ব কবরখানা সস্তায় কিনে নিয়েছিলেন আমার ঠাকুর্দা।  তিনি তো আর ভাবেননি কোনোদিন এখানে থাকবেন। তার প্ল্যানে ছিল স্কুল। তাই কবরখানা কিনতে তাঁর আটকায় নি। বাড়ি বানাবার সময় মাটি খুঁড়তে গিয়ে গোটা দুয়েক কঙ্কালও নাকি পাওয়া গেছিল। তা সেই বাড়িতেই আমার বড় হয়ে ওঠা। লম্বা ঝুল বারান্দার তলায় একটা লম্বা রক। যেখানে সকাল সন্ধ্যা লোকজনকে আড্ডা মারতে দেখেছি আমি। আর রাস্তার ওপারে এ মোড় থেকে ও মোড় নখিপুরের জমিদার বাড়ি। গোটা কয়েক বাড়ি নিয়ে এই টিপুসুলতান রোড। আমাদের বাড়ির সামনে ওই নখিপুর জমিদার বাড়ির গায়ে পর পর ছিল কতগুলো দোকান। একদম বাঁদিকে জয়দেবদার মিষ্টির দোকান। তারপর নেপালদার ইলেক্ট্রিকের দোকান। তারপর কালুর লেডিস টেলারিং, তারপর একটা ধোপার দোকান আর শেষ মাথায় একটা ছোটো সোনার দোকান। জয়দেবদা সন্ধ্যে থেকেই আড্ডা মারত আমাদের রকে বসে। আর আমরা জানালা খুলে বিকেলের সিঙ্গাড়া ইত্যাদি বাড়িতে বসেই পেয়ে যেতাম। তার জন্য আর রাস্তা পেরোতে হতো না। একটা বড় কাঠের বারকোশের উপর আরেকটা কাঠের বারকোশ চাপিয়ে তার উপর তার বিরাট ভুঁড়ি নিয়ে চেপে বসত জয়েদেবদা। আর মাঝে রাখা ছানার জল ঝরানো হতো ওভাবেই। তার থেকে মিষ্টি তৈরি হতো। মা এ কারণেই জয়দেবদার বানানো মিষ্টি খেতে চাইত না।
সকালবেলা যে ছেলেটা দোকান খুলত তাকে প্রথম প্রশ্ন করত জয়দেবদা –‘পাখিকে খেতে দিয়েচিস’? পাখি বলতে কাক আর একদল গোলা পায়রা যারা আশ্রয় নিয়েছিল এদিক ওদিকের পুরোনো বাড়ির কার্নিস আর ভেঙ্গে পড়তে থাকা ফাঁকা ঘরগুলোতে।
একজনের কথা মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। একজন মধ্য বয়স্ক বেঁটে খাটো টাক মাথা লোক মাঝে মাঝেই গলা ছেড়ে ওই দোকানে বসে গেয়ে উঠত –‘বসন্ত চলে যায় আমার এ ভূবন হতে...’। মা সেই গান শুনে প্রায়ই বলত –‘ওরে বুড়ো, তোর বসন্ত বহুদিন চলে গেছে’। জয়দেবদার দোকান থেকে ফুট দশেক বাঁহাতে ছিল একটা লম্বা দেওয়াল। যা সারাক্ষণ ভিজে থাকত মুতে। একটা খোলা পাব্লিক ইউরিনাল। যেখানে মুততে কোনো বাধা নেই। কেউ বকতে আসবে না। অথচ সেই মুত পেরিয়ে একদিন দেওয়ালে স্টেন্সিল কেটে মাওয়ের ছবি কেউ এঁকে দিয়ে গেছিল। তারপর থেকে ভয়ে অনেকদিন কেউ ওখানে মুততে যায় নি।
তখনো পাড়ার উঠতি চ্যাংড়াদের মিষ্টি খেয়ে বলত শুনেছি –‘মিষ্টিটা এখনো গলা থেকে নামেনি আর তুই পয়সা চাইছিস?’
সেইসব আড্ডা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল। নখিপুরের জমিদার বাড়ি ভেঙ্গে গোটা চারেক ফ্ল্যাট উঠল। জয়দেবদারা যে কোথায় চলে গেল তারপর, কেউ বলতে পারে না সে কথা।
জয়দেবের মিষ্টি দোকানটা আর নেই, মুদিয়ালি বাড়ির জিন রমণীর সাথে
সে যে কেন গেল হাইড্রায় মিষ্টি বেচতে!!! কেন যে যায় সবাই কোথায়
যে যায়। আসলে থাকার মধ্যেও একটা যাওয়া কাজ করে।
বাটা মাছ খেতে ভালোবাসত যে নেপালদা সেও হারিয়ে গেল।
কালুর লেডিস টেলারিং-এর কালু ছিল এক রঙিন চরিত্র। তার দোকানের অ্যাসিস্টেন্ট ছিল একটি মেয়ে। আমাদের লক্ষ্মীর ভাষায় তার নাম ছিল বুনুনি। যার দুটো মাই কালু চান্স পেলেই টিপত পকাপক। সে ঘটনা আমাদের লক্ষ্মীর গোয়েন্দা চোখ এড়িয়ে যেতে পারে নি। তো বেশ চলছিল এরকম হঠাৎ একদিন কালু তার ফ্যামিলি সমেত ভেজাল তেল খেয়ে হাসপাতালে ভরতি হলো। বৌটা মারা গেল হাসপাতালেই। তারপর বুনুনি বৌয়ের জায়গা নিলো আর বুনুনির জায়গা নিল আরেকটি মেয়ে। লক্ষ্মী যার নাম দিয়েছিল পাকাচুলি। কোঁকডা ঘন কালো চুলের খানিকটা পাকা ছিল বেচারির। তারপর পাকাচুলির বুক মাপা চলতে লাগল। এর জন্য কেউ কালুকে ক্যালায় নি। শুধু পাড়ার কালী পুজোয় কালু ঠিকঠাক চাঁদা দেয় নি বলে তার দোকানের সামনে হেগে রেখেছিল কেউ আর দোকানের তালাগুলোয় গু মাখিয়ে রেখেছিল।  
আমাদের পাশের বাড়ি ভাড়া থাকত এক বুড়োবুড়ি আর তাদের পাগল মেয়ে আর তার বামপন্থী ভাই। ওই সোনার দোকানে চুপিচুপি গয়না বিক্রি করতে দেখেছি ওই বুড়িমাকে। তারপর তারা গত হলে সেই ভাই আর তার পাগল বোন ছিল আরো কিছুদিন। পাগল বোনটাকে মাঝে মাঝে রুটি খেতে দিত আমাদের রান্নার মেয়ে লক্ষ্মী। তা টের পেয়ে তার ভাই তারপর বাইরে থেকে তালা মেরে যেত। না খেতে পেয়ে পেয়ে বোনটা একদিন মারা গেল। বামপন্থী ভাই বেশ কয়েকদিন পর ফিরে এসে দেখল বোনের গায়ে পিঁপড়ে ধরে গেছে। তারাও আর নেই ও পাড়ায়। যেভাবে আমাদের বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেছে। তবু ও বাড়ির কথা মনে পড়লে আমার সেই জিন রমণীর কথা মনে পড়ে। যে নাকি ওই বাড়ি আঁকড়ে ছিল বহুদিন। অবশ্য সে কথা আমাকে বলেছিল মাঝারের এক ফকির, কারণ আমি সাদা সিল্কের জামা পরে ঘুরতে দেখতাম এক সুন্দরীকে। যা আর প্রমাণ করার উপায় নেই। কারণ ওই বাড়িটাই আর নেই আমাদের। এখন শুনি ওটা গোডাউন হয়েছে। ফ্ল্যাট হতে পারে নি এখনও।