Monday, September 17, 2018

কোলকাতা – মুম্বাই – ইস্তানবুল – স্টকহোম/ দ্বিতীয় পর্ব











তো হাইড্রার একটা তুমুল বোহেমিয়ান ইতিহাস আছে। আর্টিস্ট, লেখক, গায়কদের আড্ডাখানা ১৯৬০-এর সে সময়টা ছিল বিল-এর বারে। দেওয়ালে কারপেট, মাটিতে কুশন, দেওয়ালে পিন দিয়ে আঁটকানো কবিতা। একে বোলা হোত – ‘The most important watering hole in the Mediterraninean for the alcoholic jet set’.  এখানে মাঝে মাঝে জ্যাকি ওনাসিস আর মিক জ্যাগারকেও দেখা গেছে।
হেনরির এই বইটার ব্যাক ড্রপো ছিল হাইড্রা। সেখানে একজন কবি যার নাম মিস্টার ব্লু। সেই থেকে আমি হেনরিকে মিস্টার ব্লু বলে ডাকি।
অতএব মিস্টার ব্লুর সাথে প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর, কোলাকুলির পর আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলাম। একটা ঝাঁ চকচকে ট্যাক্সি। লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ। চালকের ডান দিক চেপে একটা ছোট জিপি আর এস স্ক্রিন। যাতে সমানে রাস্তার দিকনির্দেশ ফুটে উঠছে 
হেনরির পাতলা চুল, দাঁড়ি। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে চলাফেরা করে। আমার থেকে বছর দশেকের বড়। কিন্তু তার সারা শরীর থেকে একটা বন্ধুত্বের উষ্ণতা যা আমাকে এই শূন্য তাপাঙ্কেও আরাম দিচ্ছিল। আমরা কথা বলছিলাম বুকাওস্কি নিয়ে। আমাদের দুজনেরই প্রিয় এই অ্যামেরিকান কবি। হেনরির বই উইক্স লাইক দিস-এর ব্যাক কভারে জেফরি এইচ উইনবার্গ-এর তিনটে লাইন হেনরিকে আরো প্রিয় করে তুলেছিল। ‘The spirit of Bukowski is walking the cobblestone streets of Sweden, alive between the lines of Henry Denander’s poetry. Everyday struggles and triumphs of being human knows no international boundaries here’.  







ওখান থেকে সোজা হোটেল। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এ এফ চ্যাপম্যান-এ। একটা ছোট্ট দ্বীপ Skeppsholmen-এর সমুদ্রের খাঁড়িতে এই জাহাজটি দাঁড়িয়ে আছে। এক্সময় সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এই জাহাজকে এখন হোটেলে পরিণত করা হয়েছে। যেখান থেকে হেঁটে যাওয়া যায় শহরের কেন্দ্রস্থলের কালচারাল সেন্টারে যেখানে আমার কবিতা পাঠ হওয়ার কথা। আমার জন্য বরাদ্দ হলো একটি কেবিন। এবং আমার থাকার খরচ কামিনী প্রেস দেবে ঠিক হয়েছে শুনলাম। স্টকহোমের এই কামিনী প্রেস কবিতার মিনি বই ছাপে। হেনরি দিনানদার নিজের হাতে এই বুটিক বইগুলো ছেপে বাঁধাই করে। ইংরেজিতে কবিতা লেখে। ছবি আঁকে। গিটার বাজায়।
ঘরের চাবির বদলে আমার হাতে রিসেপশন থেকে ধরিয়ে দেওয়া হলো একটা কার্ড। ক্রেডিট কার্ডের থেকে একটু বড় সাইজের। ওটাই নাকি চাবি। কি-কার্ড। এ পারের লোহার দরজায় লকের উপর কার্ড ঢোকানোর একটা স্লট। কার্ড ঢুকিয়ে ঘটাং করে দরজা খুলে একটা ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে সোজা জাহাজের ডেকে। জাহাজের ডেকে দেখি আমার আরেক বন্ধু বোয়েল তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার কার্ড ঢুকিয়ে ডেক থেকে নীচে জাহাজের খোলের ভেতর নেমে একতলা ঘরটায় ঢুকলাম সবাই, তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে রওনা দিলাম আমার জন্য বরাদ্দ করা ঘরটার দিকে। পর পর সার দেওয়া ঘরের উপর নম্বর লেখা আছে। দু নম্বর ঘর আমার। কামিনী প্রেসের সদ্য প্রকাশিত মিনি কবিতার চ্যাপ বুক র‍্যাপিং পেপারে মুড়ে হেনরি নিয়ে এসেছে আমার জন্য। ব্যাগ খুলে কোলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া গ্রাফিত্তির বইপত্তরগুলো এবার ওদের হাতে তুলে দেওয়ার পালা আমার। এসবের মধ্যে বোয়েলের মিষ্টি ছোট্ট মেয়েটা আমাকে একটা পেঙ্গুইনের লকেট হাতে দিলো। লাকিচার্ম। স্টকহোমে পাওয়া আমার সেরা উপহার।
বোয়েল বলল, ‘চেঞ্জ করে নাও। তারপর আমরা ডিনারে যাবো’।
সন্ধ্যেবালা ডিনার খাওয়ার সাহেবী অভ্যাস আমার নেই। এ ব্যাপারে আমি নিতান্তই পাতি বাঙালি। দেরি করে বেধড়ক খেয়ে রোজ সকালে মুখ টকে যায়। রাত এগারোটা বারোটার আগে খিদে চাগাড় দেয় না। অতয়েব আমার প্রিয় এক কাপ কালো কফি খেয়ে আমি ডিনার সারলাম।
‘জাস্ট এক কাপ কফি? আর কিছু খাবে না তুমি? আমরা কিন্তু খাওয়া দাওয়া করব’।
‘করোনা, অসুবিধে নেই। আমার খিদে নেই। তোমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই কফি’।







কাচের বেঁটে গ্লাসের ভেতর থেকে থর থর করে কাঁপছে মোমবাতির আলো। আরো কতগুলো হলুদ আলো পড়েছে টেবিলটার উপর। হোটেলের ভেতরটা বেশ গরম। গায়ের চামড়ার জ্যাকেটটা চেয়ারে চাপিয়ে কিছুটা সহজ হওয়া গেল। টেবিলের বাঁদিকটা কাচে মোড়া। এখানে বসেই বাইরের সমুদ্রের খাঁড়িটা দেখা যাচ্ছে। একটা জাহাজ খুব ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে অন্য আরেকটা দ্বীপের দিকে।
‘কালকে আমায় কী করতে হবে’?
‘তুমি কী করতে চাইছ’?
‘মানে আমার সাথে আমাদের শর্ট ফিল্মগুলো আছে। যে কোনো একটা শর্ট ফিল্ম দিয়ে আমরা অনুষ্ঠান শুরু করতে পারি’।
‘ঠিক আছে। কাল তোমার অনুষ্ঠান ছটা থেকে। তুমি এখন বিশ্রাম নাও। কাল বিকেল চারটেতে দেখা হবে আবার’।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে বোয়েল আর আমার মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল সেগুলো নিয়ে ভাবছিলাম আমি। আরেকবার আমার ব্যক্তিগত নোটস-এ চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। এমনিতেই স্টেজে উঠলে কথা খুঁজে পাই না আমি। মানে একটা বৈদিক মন্ত্র দিয়ে শুরু করলে খারাপ হয় না। ওয়েস্ট ল্যান্ড খানিকটা সাহায্যে আসতে পারে হয়ত। মানে এমন কিছু দিয়ে শুরু করা যা সবাই জানে আরকি। আর ভাবছিলাম সেই প্রশ্ন উত্তরের কথাগুলো যা আমার আর বোয়েলের মধ্যে দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। ওদিকে আরো একটা সাক্ষাৎকারের জন্য বহু দিন প্রশ্ন পাঠিয়েছে সাউথ আফ্রিকান কবি গ্যারি কামিস্কি তার ডাই হার্ড ইন্টারভিউস-এর জন্য। বেশির ভাগ প্রশ্নই প্রায় একই রকম। তাই বয়েলকে পাঠানো উত্তরগুলো ওকেও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। যা ইয়োরোপ থেকে ফিরে আসার পর প্রকাশিত হয়। এবং পরে বোয়েলের কাছে জানতে পারি এই সাক্ষাৎকারটা সুইডিশ অনুবাদ হয়ে পোস্টস্ক্রিপ্টামে প্রকাশিত হবে।  


------------
Painting By Henry Denander              




Monday, September 10, 2018

কোলকাতা – মুম্বাই – ইস্তানবুল – স্টকহোম /প্রথম পর্ব

ইস্তানবুল হয়ে প্লেনটা ঢুকে পড়ল একটা ঘন মেঘের ভিতর। ছাই সবুজ এরকম মেঘ আগে কখন দেখিনি। কলকাতার বত্রিশ ডিগ্রি থেকে সোজা শূন্য তাপাঙ্কের স্টকহোমে নেমে পড়লাম। খানিকটা নার্ভাসনেশখানিকটা উত্তেজনাখানিকটা আকাঙ্ক্ষার চড়া পারদ ওঠা নামা করছিল শিরদাঁড়া বরাবর। ইয়োরোপে এই প্রথম, তাও একা একা। বই ভর্তি গন্ধমান ব্যাগটার কথা ভাবতেই ভয় করছিল। তাই ভাবা বন্ধ করে আশেপাশের সুন্দরী কন্যাদের দিকে মনোযোগের যোগব্যায়ামে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।
আমেরিকান বন্ধু, কবি এরিক ভাটনে বলেছিল বটে যে, ইস্তানবুলটা ঘোরা দরকার। ওটা একটা ম্যাজিকাল শহর। ইয়োরোপের বুলন্দ দরওয়াজা। কিন্তু ইস্তানবুলের এয়ারপোর্ট ছাড়া ট্রানজিটের কয়েক ঘন্টায় আর কিছু দেখা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া ইস্তানবুলে তো কোন বন্ধুও নেই যে, তার হাত ধরে ওরহান পামুকের শহর দেখতে বেরিয়ে পড়ব। কলকাতায় অবশ্য আগেই দেখে ফেলেছিলাম ফতিহ  আঁকি-র (Fatih Akin)  ফিল্ম Auf der Anderen Seiti,  অন্য পাশটায়। ইউকে রিলিজের সময় যার নাম দেওয়া হয়েছিলস্বর্গের কিণারায়। অবশ্য আমার জার্মান নামটাই সঠিক লেগেছিল, পরের কাব্যিক নামটার থেকে এই তুর্কি-জার্মান পরিচালকের এই ফিল্ম ছিল জার্মান আর তুর্কির ভেতরকার চাপা উত্তেজনা নিয়ে।  প্রথম আর দ্বিতীয় প্রজন্মের তুর্কি-জার্মানদের ভেতরকার ফাঁক আর টানাপোড়েন নিয়ে। নিজের সঠিক পরিচয়ের খোঁজ আর পুরোনো দেশটার প্রতি টান নিয়ে, যখন ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়ানে নাম লেখাচ্ছে তুর্কি।

ইস্তানবুলের রাস্তায় কতগুলো বাচ্চা ব্যাগ ছিনতাই করছে এবং তাদের তাড়া করে যাওয়া মেয়েটিকে শেষ অবধি বাচ্চাগুলো জাস্ট গুলি করে মেরে দিচ্ছে দেখে একটা চাপা অস্বস্তি আমার ভিতর ভিতর কাজ করছিল,থাকঅন্য আরেক সময় আসা যাবে ইস্তানবুলে। যদিও তুর্কি ক্লাসিক্যাল মিউজিক আমার গোটা প্লেন-পথের সঙ্গি ছিল। ইচ্ছেও হচ্ছিল ইস্তানবুলে ক্লাসিক্যাল মিউজিক শেখানোর সব থেকে নাম করা Uskudar Musiki Cemiyeti  দেখে আসার। দেখে আসা সেইসব লম্বা গলা তানবুরআউদকুডুম ড্রাম ইত্যাদি। বেটোভেনের ন নম্বর সিমফনিতেও তো এই তুর্কি ইন্সট্রুমেন্টের ব্যবহার আছে। এবং মোর্জাটও তাঁর অপেরায় তুর্কি থিম ব্যবহার করেছিলেন। সিমফোনি অর্কেস্ট্রায় আজ ব্যবহৃত মন্দিরা (করতাল)ঘন্টা তো এসেছে তুর্কিদের হাত ঘুরেই। সেই অটোমান সাম্রাজ্যের হারেম মিউজিক থেকে শুরু করে আজকের এই ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়ানের হাত ধরা আধুনিক তুর্কিস্থান এবার আর দেখা হলো না আমার। শুধু ঝকঝকে ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে ভারতীয় টাকা ভাঙ্গাতে গিয়ে দেখলাম সেটা ভাঙ্গানো গেলো না।  

১৭ই নভেম্বর ২০১০


জঙ্গলে সবুজ হয়ে থাকা সুইডেনের ঝকঝকে শহর স্টকহোমে আমার কবিতা পাঠ, কবিতার ওয়ার্কশপ ইত্যাদি। গত একবছর ধরে আমার কয়েকজন সুইডিশ কবি বন্ধু চাইছিলেন আমি ওদের ওখানে গিয়ে কবিতা পড়ি। কিন্তু আমার মতো একজন স্ট্রিট পোয়েটের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু খরচ সাপেক্ষই নয় প্রায় অসম্ভব ছিল। প্লেনের ভাড়াই তো প্রায় আধ লাখ টাকার মতো, তার উপর থাকা খাওয়া। ইয়োরোপের অন্যান্য শহরের তুলনায় স্টকহোম খুবই এক্সপেন্সিভ। অতএব আমার কবিতা নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে একথা তাদের জানাতেই তারাই নেমে পড়ল কীভাবে আমাকে স্টকহোমে নিয়ে যাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে। আমার আরো একটা আবদার ছিল। রিটার্ন টিকিটটা যেন এক মাস বাদের হয়। অর্থাৎ কিনা এযাত্রায় আরো কটা দেশ ঘুরে ফেলা। এবং শেষ অবধি লটবহর সমেত এই বঙ্গ সন্তান ১৭ই নভেম্বর ২০১০-এর সন্ধ্যায় স্টকহোমে। প্লেন থেকে নামতেই প্রাথমিক তীব্র ঠাণ্ডার ঝটকাও মন ভালো করে দিচ্ছিল, ভালোই লাগছিল এয়ারপোর্টের গেট পেরোতে পেরোতে। 
মিস্টার ব্লু ইজ ওয়েটিং ফর ইউ। মিস্টার ব্লু আমার জন্য অপেক্ষায়। এতদিনের ভারচুয়াল বন্ধুত্বের পর এই রিয়ালিটির কোলাকুলি স্বপ্নের মতো যেন। ২৬ কিলোর ব্যাগটার টলমল অবস্থানের হ্যাঁচকা, হাতের আঙুলে ক্সলশিটে ফেলে জানান দিলো গ্রাউন্ড রিয়ালিটির কথা।
এই মিস্টার ব্লু বা নীল মানুষের একটা আলাদা গল্প আছে। হেনরি দিনানদার একজন সুইডিস কবি। আমার অনেক দিনের বন্ধু। এথেন্সের কাছে হাইড্রা বা হুইড্রা (আমি জানতাম হাইড্রা কিন্তু পরে হেনরির মুখে শুনলাম স্থানীয় লোকজন ওই দ্বীপটাকে আদর করে ডাকে হুইড্রা) আইল্যান্ডে ওর একটা ছোট্ট বাড়ি আছে। সঙ্গে ছবি আঁকার স্টুডিও। এবং লাগোয়া একটা পুরোন বইয়ের দোকান। যেটা ও যখন ইচ্ছে হয় তখন খোলে। পুরো দ্বীপটাতেই কোনো গাড়ি চলে না। আছে জল-ট্যাক্সি যা দ্বীপের চারদিকে সমুদ্রে পাক দেয়। আর মাল বওয়ার জন্য সারিসারি গাধা। গাঢ় নীল সমুদ্র ঘেরা এই দ্বীপটাতে মাঝে মাঝে গিয়ে থাকে হেনরি। ছোট ছোট বাড়ি ঘেরা, পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তারা চলে গেছে এদিক ওদিক। নেটে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখে এই হুইড্রার প্রেমে পড়ে গেলাম আমি। সেই সময়ই দুটো বই হাতে এলো। একটা হেনরির। কামিনী প্রেস প্রকাশিত কবিতার মিনি বই ‘দা পোয়েট্রি অফ মিস্টার ব্লু’ আর অন্যটা সাউথ আফ্রিকান কবি গ্যারি কামিস্কি আর এভা কোয়ালস্কা সম্পাদিত ডাই হার্ড প্রেসের ‘হু ওয়াজ সিনক্লেয়ার বেলেস’। এই সিনক্লেয়ার বেলেস একজন সাউথ আফ্রিকান কবি। ১৯৬০-এ উইলিয়াম বারোজ, গ্রেগরি করসো, ব্রায়ান জিসিন-এর সাথে এক সাথে লিখেছিলেন সেই প্রবাদ প্রতিম কাট আপ উপন্যাস ‘মিনিটস টু গো’। বাকি আমেরিকান কবিদের মনে রাখলেও এই কবিকে কেউ মনে রাখেনি। কেন তিনি সাউথ আফ্রিকান বলে? আজ ২০১০এ এসে গ্যারিকে বই করতে হচ্ছে, ‘হু ওয়াজ সিনক্লেয়ার বেলেস’। প্যারিসে লোকজন তাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসেছে আবার। ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিতে পেরেছে গ্যারি।
১৯৫০ নাগাদ তার জন্মস্থান উগানডা থেকে প্যারিসে চলে আসেন সিনক্লেয়ার। অলিম্পিয়া প্রেসের সম্পাদক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। থাকতেন সে সময়ে বিট হোটেলে। যেখানে তখন বারোজ, জিসিন, করসোদের আনাগোনা। আড্ডা। বারোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ সম্পাদনার কাজও তিনি করেছিলেন।
তা এই বইটা থেকে হাইড্রা সম্বন্ধে আরো কিছু তথ্য আমাকে উসকে দেয়। পরে জানতে পারি আমার অন্যতম প্রিয় গায়ক লিওনার্ড কোহেনের একটা সময় কেটেছে হাইড্রায় আড্ডা মেরে। উপন্যাস লিখে। আর হেনরির প্রতিবেশী এখন কোহেন। হেনরির একটা কবিতা আছে এটা নিয়ে।




আমাদের মধ্যে একজনের তো ভুল হতে পারে না

আমি খুব স্বপ্ন দেখছি, প্রায় প্রত্যেক রাতে আর গত রাতে আমার সাথে দেখা হয়ে গেল লিওনার্ড কোহেনের অ্যান্টিবস স্কোয়ারে, একটা ছোটো ফ্রেঞ্চ শহর নিসের ঠিক বাইরে, উনি খুবই আমায়িক আর ওঁর মনে ছিল সেই বইটার কথা যেটা আমি ওনাকে পাঠিয়ে ছিলাম আর অবশ্যি একভাবে দেখতে গেলে আমরা তো প্রতিবেশী গ্রিসের ওই ছোট্ট দ্বীপটার আর উনি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন ওঁর ফ্ল্যাটে যেখানে উনি থাকছিলেন, আর ঠিক দরজার বাইরে দেখি ওই উঁচু সিড়িগুলো পেরিয়ে, আমাদের দেখা হয়ে গেল আমার পুরোন বন্ধু একের সাথে, আমরা বিশ্বাস্ করতে পারছিলাম না, কী অদ্ভুত যোগাযোগ আর সেও লিওনার্ডের একজন বড় ফ্যান আর যখন ওকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো ফ্ল্যাটে ও খুব অবাক হয়ে গেল আর কিছুক্ষণ পর একে জড়তা কাটিয়ে উঠল আর তখন লিওনার্ড আমাদের কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তাকে থামিয়ে একে শুরু করল পুরোন চুটকি আর গল্প বলা, লিওনার্ড এতটাই অমায়িক আর মম্র স্বভাবের যে তিনি ওকে বলত দিলেন আর হাসতে লাগলেন কিন্তু শেষমেশ দেওয়াল থেকে নামিয়ে আনলেন তাঁর পুরোন গিটার, গিটারটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সংস ফ্রম এ রুম-এর কাভারের ছবির মতো, ওটা ঝোলানো ছিল তাঁর হাইড্রা বাড়ির দেওয়ালে যেখানে জানালার ধারে বসে থাকে মারিয়্যান আর অ্যান্টিবস-এর বাড়িটাও দেখতে একই রকম, সব সাদা আর লিওনার্ড তাঁর গিটারের তারে আঙুল চালাতে শুরু করলেন এমনকি একেও চুপ করে গেল আর হঠাৎ লিওনার্ড গাইতে শুরু করলেন আর আমি ভাবলাম কী অসম্ভব একটা মুহুর্ত আর আমি কীভাবে লিওনার্ডের কাছে বসে আছি আর উনি গাইছেন 'দা স্ট্রেঞ্জার সং' তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আর তারপর হঠাৎ একে গলা মেলাতে লাগল তেড়ে একটা মাতালের মতো আর সেখান থেকে আমার স্বপ্নটা এগিয়ে চলল আর কীভাবে যে সেটা শেষ হলো আমি মনে করতে পারছি না, যদি সত্যি তা শেষ হয়ে থাকে, হয়ত ওরা এখনো গেয়ে চলেছে সেই ঘরটায় যেটা প্লাস অ্যান্টিবস-এর সামনে।         

হেনরি মিলারের গ্রিস নিয়ে লেখা বইটাও আরেকবার উলটে পালটে দেখি, দা কলোসাস অফ মারুসি। এই সময়ে আমার চারদিকে কতগলো অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। সেই ঘটনাগুলোকেই জাস্ট শব্দের ভেতরে আঁটকে রাখি আমি – ‘অজয়ের পাড় ধরে জয়দেব কোথায় যে হেঁটে চলে গেল’ কবিতাটায়। যার একটা ইংরেজি ভারসানও করেছিলাম মূলত হেনরির প্রোরোচনায়।

অজয়ের পাড় ধরে জয়দেব কোথায় যে হেঁটে চলে গেল

জয়দেবের মিষ্টি দোকানটা আর নেই। মুদিয়ালী বাড়ির জিন রমণীর সাথে সে যে কেন গেল হাইড্রায় মিষ্টি বেচতে!!! কেন যে যায় সবাই কোথায় যে যায়। আসলে থাকার মধ্যেও একটা যাওয়া কাজ করে।
সমুদ্র নীল আছড়ানো একটা ফুলের নাম হাইড্রা। হারকিউলিস যে নমুখো জলের জানোয়ারটাকে মেরেছিলো, মেরেই তো ফেলেছিলো প্রায়। শুধু অমর একটা মাথা কেটে কোথায় যে পুঁতে রেখেছিলো। কোথায় যে? স্মৃতির ঝাপসারা শব্দেরা ফুটে আছে মদ গলানো এই সাইক্লোপিয়ান পাথর আর ঘাসের জড়াজড়ি হাওয়ায়।

  মেয়েটা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে চুমু আর চুমু। জড়ানো অস্তিত্বরা ধীরে ধীরে পিট পিট করে আরাম পেতে থাকে। আঙুলের নিশপিশ আর সর্বনাশ আমি ভুলে যেতে থাকি। কে আর জানতো এটা স্রেফ নমস্কার শুধু। এরকমই হয় পাশের বাগানে সূর্য উঠলে ওই লেবু গাছটা বরাবর। না না ওটা অলিভ নয় আমি জানি। মদ আর টকচানো অলিভে জিভ জড়িয়ে মড়িয়ে পরিত্রাহি কতবার।

পোকা মারার মরণ সঙ্গীত গেয়ে ওই রমণীদঙ্গল ওষুধ ছড়ায় না এইখানে। এখানের মরণের গান শুধু একটা পাহাড় থেকে ছুটে আরেকটা পাহাড়ের মাথায় এক দমে উঠে যাওয়া শুধু আর আছড়ানো জঙ্গী চুলের ঢেউয়ে বারবার শরীরের পোকাগুলোর চোরাচালান। নীল-সাদার এই দেশে তাই মিস্টার ব্লু হয়ে পড়া সোজা। তাতো হেনরি দিনানদার জেনেছিলো। কীভাবে মাথার ভিতর থেকে কবিতার শব্দগুলো হঠাৎ চলে গিয়ে রঙ হয়ে ধরা দিতে পারে অন্য কোথাও। তা মিস্টার ব্লুও জানতো না। অথচ সব খোঁজ সে মেয়েটার ছিল। আর জেনেছিলো হেনরি মিলার। সেই চুপ। A pause in the musical score of creation by an expert calligrapher.

আমার অ্যাকোরিয়ামের মিষ্টি মাছটা যে আমাকে খুব ভালোবাসত আজ দেখি হঠাৎ সে নেই। কেন যে যায় সবাই কোথায় যে যায়। আসলে যাওয়ার মধ্যেও একটা থাকা কাজ করে। আসলে পাথরগুলোই সব পাগল, ওই সব ম্যাজিকাল আলোতে থেকে থেকে পাথরত্ব খুইয়ে ফেলেছে অজান্তেই। হৃদয়ের বদলে তাই এক আলো খেলা করে। সে নেই অথচ সে চুল খুলে চেয়ারে বসে থাকে রোজ। মাথা নিচু করে এক মনে ভাবে। আমি তার দিকে তাকাই না পাছে ফের বিরক্ত হয়ে চলে যায়। মিষ্টি মাছটার সাথে ভেসে ভেসে। অথচ সেও তো চুমু চেয়েছিলো একদিন। কাঁঠাল চাঁপারও পেকে উঠে ফুটে উঠতে বেশ খানিকটা তীব্র রোদের প্রয়োজন হয়। এই সব গাছেরাও জানে, জানে সেই মৃত্যুর পাগলামো। ঘেন্নার ছেলেমানুষি ছেলেখেলা। তাকে কী করে ডাকি এই অন্ধকারে সে কি আর পথ খুঁজে পাবে? যেন পথ খুঁজে পেলে বেঁচে যাবে এই অন্ধকার ভালোথাকাগুলো।

মদ বেচতো যে লোকগুলো তারাতো জানতো শব্দ পাগলদের তীব্র তৃষ্ণা শিকড়ের চোঁচোঁ আর্তির মায়া তারা কীভাবে কাটাবে। সবাই তো তাই ভাবে সব কিছু জানে আসলে কিছুই জানা যায় না কোনোদিন। কারণ কিছুই জানার কোনো দরকার নেই। কিছুই চেনার কোনো দরকার নেই। ট্যাবলেট খেতে খেতে ট্যাবলেট না খাওয়ার মন্ত্রণা তাকেও দিতে হতে পারে একদিন। ভালোবাসতে গেলে  না ভালোবাসাটাও আগে শিখে নিতে হয়। শব্দতার রক্ষাকবচ হবে বলে সর্বনাশ রোজ আসে কবচ ভিক্ষা করে নিতে। নিয়ে যায় নিয়ে যেতে থাকে সমস্ত না পারাগুলো, বাস্তবতা, প্রতিজ্ঞার শব।

আকাশের অনেক লাল আর চোখ ভরতি নীল নিয়ে একটা আস্ত সন্ধ্যা নামছে ফ্ল্যাটের উপর। ফ্ল্যাটটা কি ঢাকা পড়ে যাবে সন্ধ্যায়!! আর যে রমণী আমার জন্য বৃষ্টি নাচ নাচছে তার শুকনো বাগানে হাজার সমুদ্র পেরিয়ে তাকে বোলো এখানে বৃষ্টি পড়ছে খুব। শান্তিতে ঘুমোচ্ছে ক্লান্ত কুকুর দুটো, উকুনের কুটকুটগুলো আর আমার সারা শরীর বেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে মিষ্টি মাছেদের অমরত্ব আর সেইসব আলোর পাগলামি।