Monday, September 17, 2018

কোলকাতা – মুম্বাই – ইস্তানবুল – স্টকহোম/ দ্বিতীয় পর্ব











তো হাইড্রার একটা তুমুল বোহেমিয়ান ইতিহাস আছে। আর্টিস্ট, লেখক, গায়কদের আড্ডাখানা ১৯৬০-এর সে সময়টা ছিল বিল-এর বারে। দেওয়ালে কারপেট, মাটিতে কুশন, দেওয়ালে পিন দিয়ে আঁটকানো কবিতা। একে বোলা হোত – ‘The most important watering hole in the Mediterraninean for the alcoholic jet set’.  এখানে মাঝে মাঝে জ্যাকি ওনাসিস আর মিক জ্যাগারকেও দেখা গেছে।
হেনরির এই বইটার ব্যাক ড্রপো ছিল হাইড্রা। সেখানে একজন কবি যার নাম মিস্টার ব্লু। সেই থেকে আমি হেনরিকে মিস্টার ব্লু বলে ডাকি।
অতএব মিস্টার ব্লুর সাথে প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর, কোলাকুলির পর আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলাম। একটা ঝাঁ চকচকে ট্যাক্সি। লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ। চালকের ডান দিক চেপে একটা ছোট জিপি আর এস স্ক্রিন। যাতে সমানে রাস্তার দিকনির্দেশ ফুটে উঠছে 
হেনরির পাতলা চুল, দাঁড়ি। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে চলাফেরা করে। আমার থেকে বছর দশেকের বড়। কিন্তু তার সারা শরীর থেকে একটা বন্ধুত্বের উষ্ণতা যা আমাকে এই শূন্য তাপাঙ্কেও আরাম দিচ্ছিল। আমরা কথা বলছিলাম বুকাওস্কি নিয়ে। আমাদের দুজনেরই প্রিয় এই অ্যামেরিকান কবি। হেনরির বই উইক্স লাইক দিস-এর ব্যাক কভারে জেফরি এইচ উইনবার্গ-এর তিনটে লাইন হেনরিকে আরো প্রিয় করে তুলেছিল। ‘The spirit of Bukowski is walking the cobblestone streets of Sweden, alive between the lines of Henry Denander’s poetry. Everyday struggles and triumphs of being human knows no international boundaries here’.  







ওখান থেকে সোজা হোটেল। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এ এফ চ্যাপম্যান-এ। একটা ছোট্ট দ্বীপ Skeppsholmen-এর সমুদ্রের খাঁড়িতে এই জাহাজটি দাঁড়িয়ে আছে। এক্সময় সমুদ্র পাড়ি দেওয়া এই জাহাজকে এখন হোটেলে পরিণত করা হয়েছে। যেখান থেকে হেঁটে যাওয়া যায় শহরের কেন্দ্রস্থলের কালচারাল সেন্টারে যেখানে আমার কবিতা পাঠ হওয়ার কথা। আমার জন্য বরাদ্দ হলো একটি কেবিন। এবং আমার থাকার খরচ কামিনী প্রেস দেবে ঠিক হয়েছে শুনলাম। স্টকহোমের এই কামিনী প্রেস কবিতার মিনি বই ছাপে। হেনরি দিনানদার নিজের হাতে এই বুটিক বইগুলো ছেপে বাঁধাই করে। ইংরেজিতে কবিতা লেখে। ছবি আঁকে। গিটার বাজায়।
ঘরের চাবির বদলে আমার হাতে রিসেপশন থেকে ধরিয়ে দেওয়া হলো একটা কার্ড। ক্রেডিট কার্ডের থেকে একটু বড় সাইজের। ওটাই নাকি চাবি। কি-কার্ড। এ পারের লোহার দরজায় লকের উপর কার্ড ঢোকানোর একটা স্লট। কার্ড ঢুকিয়ে ঘটাং করে দরজা খুলে একটা ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে সোজা জাহাজের ডেকে। জাহাজের ডেকে দেখি আমার আরেক বন্ধু বোয়েল তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার কার্ড ঢুকিয়ে ডেক থেকে নীচে জাহাজের খোলের ভেতর নেমে একতলা ঘরটায় ঢুকলাম সবাই, তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে রওনা দিলাম আমার জন্য বরাদ্দ করা ঘরটার দিকে। পর পর সার দেওয়া ঘরের উপর নম্বর লেখা আছে। দু নম্বর ঘর আমার। কামিনী প্রেসের সদ্য প্রকাশিত মিনি কবিতার চ্যাপ বুক র‍্যাপিং পেপারে মুড়ে হেনরি নিয়ে এসেছে আমার জন্য। ব্যাগ খুলে কোলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়া গ্রাফিত্তির বইপত্তরগুলো এবার ওদের হাতে তুলে দেওয়ার পালা আমার। এসবের মধ্যে বোয়েলের মিষ্টি ছোট্ট মেয়েটা আমাকে একটা পেঙ্গুইনের লকেট হাতে দিলো। লাকিচার্ম। স্টকহোমে পাওয়া আমার সেরা উপহার।
বোয়েল বলল, ‘চেঞ্জ করে নাও। তারপর আমরা ডিনারে যাবো’।
সন্ধ্যেবালা ডিনার খাওয়ার সাহেবী অভ্যাস আমার নেই। এ ব্যাপারে আমি নিতান্তই পাতি বাঙালি। দেরি করে বেধড়ক খেয়ে রোজ সকালে মুখ টকে যায়। রাত এগারোটা বারোটার আগে খিদে চাগাড় দেয় না। অতয়েব আমার প্রিয় এক কাপ কালো কফি খেয়ে আমি ডিনার সারলাম।
‘জাস্ট এক কাপ কফি? আর কিছু খাবে না তুমি? আমরা কিন্তু খাওয়া দাওয়া করব’।
‘করোনা, অসুবিধে নেই। আমার খিদে নেই। তোমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য এই কফি’।







কাচের বেঁটে গ্লাসের ভেতর থেকে থর থর করে কাঁপছে মোমবাতির আলো। আরো কতগুলো হলুদ আলো পড়েছে টেবিলটার উপর। হোটেলের ভেতরটা বেশ গরম। গায়ের চামড়ার জ্যাকেটটা চেয়ারে চাপিয়ে কিছুটা সহজ হওয়া গেল। টেবিলের বাঁদিকটা কাচে মোড়া। এখানে বসেই বাইরের সমুদ্রের খাঁড়িটা দেখা যাচ্ছে। একটা জাহাজ খুব ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে অন্য আরেকটা দ্বীপের দিকে।
‘কালকে আমায় কী করতে হবে’?
‘তুমি কী করতে চাইছ’?
‘মানে আমার সাথে আমাদের শর্ট ফিল্মগুলো আছে। যে কোনো একটা শর্ট ফিল্ম দিয়ে আমরা অনুষ্ঠান শুরু করতে পারি’।
‘ঠিক আছে। কাল তোমার অনুষ্ঠান ছটা থেকে। তুমি এখন বিশ্রাম নাও। কাল বিকেল চারটেতে দেখা হবে আবার’।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে বোয়েল আর আমার মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল সেগুলো নিয়ে ভাবছিলাম আমি। আরেকবার আমার ব্যক্তিগত নোটস-এ চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। এমনিতেই স্টেজে উঠলে কথা খুঁজে পাই না আমি। মানে একটা বৈদিক মন্ত্র দিয়ে শুরু করলে খারাপ হয় না। ওয়েস্ট ল্যান্ড খানিকটা সাহায্যে আসতে পারে হয়ত। মানে এমন কিছু দিয়ে শুরু করা যা সবাই জানে আরকি। আর ভাবছিলাম সেই প্রশ্ন উত্তরের কথাগুলো যা আমার আর বোয়েলের মধ্যে দেওয়া নেওয়া হয়েছিল। ওদিকে আরো একটা সাক্ষাৎকারের জন্য বহু দিন প্রশ্ন পাঠিয়েছে সাউথ আফ্রিকান কবি গ্যারি কামিস্কি তার ডাই হার্ড ইন্টারভিউস-এর জন্য। বেশির ভাগ প্রশ্নই প্রায় একই রকম। তাই বয়েলকে পাঠানো উত্তরগুলো ওকেও পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। যা ইয়োরোপ থেকে ফিরে আসার পর প্রকাশিত হয়। এবং পরে বোয়েলের কাছে জানতে পারি এই সাক্ষাৎকারটা সুইডিশ অনুবাদ হয়ে পোস্টস্ক্রিপ্টামে প্রকাশিত হবে।  


------------
Painting By Henry Denander              




No comments:

Post a Comment