Monday, June 25, 2018

কথায় কথায় শুভঙ্কর দাশ


দেশপ্রিয় পার্ক ছাড়ালে একটু এগোলে, ডানদিকে গলির ভিতর ফ্ল্যাট। পাঁচতলার টঙের ঘরে উঠতে গিয়ে যা সিঁড়ি ভাঙলাম – জিভ বেরিয়ে গেল এই ঠাণ্ডাতেও। হাফ বোতল জল খালি করে একটি সিগারেট ধরিয়ে বসলাম শুভঙ্করদার মুখোমুখি। বললাম – সাক্ষাৎকার চাই। শুভদা বলল – ধুস, ওসব ছাড় – চল আড্ডা মারি। শুরু হলো আমাদের আড্ডা। গ্রাফিত্তির ঠেকবাজি। আড্ডার সমস্ত কালো সমেত একটা কথাবার্তা রইল এখানে।

শুভঙ্করদা তোমার লেখালিখির বয়স প্রায় ছাব্বিশ বছর – এই জার্নিতে প্রথম দিকের ভাবনা থেকে আজকের ধারণায় কতটা ফারাক এসেছে?

-ধারণায় পরিবর্তন তো এসেছেই। মানুষ তো পাল্টায়, আরকি, এখন চেষ্টা করি কবিতাকে
যতটা সহজ করা যায়, একটা communication –এর জায়গা তৈরি করা। আগে মনে হতো 
communication  জরুরি নয়। জার্নিটা খুব জরুরি, না হলে আজ যেভাবে ভাবছি সেভাবে
ভাবতে পারতাম না। এখন মনে হয়, কবিতায় শব্দের জাদুকরি দেখিয়ে কোনো
লাভ নেই। সরাসরি নিজেকে যতটা express  করা যায়।

এখান থেকে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে আসছে। অনেকেই বলেন – কবিতা নিজস্ব ব্যাপার। Communicate করা জরুরি নয় – তুমি কী বলছ?

-আমি এসব মানি না। মানি না এ কারণে – নিজস্ব হলে লিখে ট্রাঙ্কে রেখে দিক।
পড়াচ্ছে কেন? ছাপানোর কী প্রয়োজন? আমার কথাই বলি – আগে আমি একটা
জিনিস করতাম, একটা experimentation – একটা শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে অন্য জায়গায়
যাওয়া। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেখেছি সেটা বেশির ভাগ লোকের মাথার উপর
দিয়ে যাচ্ছে, ওই feelingsটা সে ধরতেই পারছে না। অনেক সহজেই ওটা বলা যায়।
কিন্তু আসলে একজন কবি এটা করার সময় ভিতরে যেটা কাজ করে তা হলো
– আমি কতটা জানি। এই যে জ্ঞান দেওয়ার প্রবণতা, এটা সব জায়গাতেই আছে।
এই করতে গিয়ে এখন সারা পৃথিবীতেই কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে।
‘ওরে বাবা কবিতা – ও তো কিছুই বুঝব না’, এটাই পাঠক বলছে। এতে লাভ
কী হলো? পাঠক হারালাম আমরা। একটা উপন্যাসের যত পাঠক, কবিতার তত
নেই – কেন? কারণ এটাই। কবিতা আর পরীক্ষার খাতা এক নয় যে কতটা জানি
জাহির করব।

অনেক কবি বলেন – ফর্ম না কন্টেন্ট এই প্রশ্নে তারা ফর্ম নিয়ে ভাবেন বেশি – তোমার কী মত?

-আমার মতে দুটোই জরুরি। আমি যখন লিখছি, আমি তো কিছু একটা করতে চাইছি।
কন্টেন্ট-ই নেই, একটা ফর্ম নিয়ে কী করব আমি? এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট কমবেশি
সব দেশেই হয়েছে। ফর্মটাই কন্টেন্ট বলা-টলা ইত্যাদি। এসব আঁতলামো তে বিশ্বাস নেই
আমার।

বাংলা সাহিত্যে এবং অন্যান্য সাহিত্যেও দেখা যায়, অনেকে তাদের কবিতাকে Anti-poetry  বা না-কবিতা বলছেন। অথচ একজন পাঠক কিন্তু সেটাকে অন্তত পড়া শুরু করার সময় কবিতা ভেবেই পড়ছেন। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত না?

-প্রায় সব কবিতা movement এই এরকম কিছু না কিছু হয়েছে। এটা আসলে চোখে আঙুল
দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা –‘দেখো আমি স্রোতের থেকে আলাদা’। Ultimately কবিতাটা কবিতাই।
হ্যাঁ কবিতা – না কবিতা ওসব কিছু না। একটা কবিতা যখন আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে
তখনই সেটা আমার কাছে কবিতা। না হলে আমি পড়বই না। তা সে অ্যান্টি পোয়েট্রি
হোক, নতুন কবিতা হোক, কংক্রিট পোয়েট্রি হোক, মিট পোয়েট্রি হোক, যা হোক...

আশির দশকে শুরু হয় গ্রাফিত্তির লড়াই। লড়াই ব্যবসায়ী কাগজের বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠানে তাঁবেদারির বিরুদ্ধে। আজ ২০১৪এ দাঁড়িয়ে কী মনে হচ্ছে – লড়াইটা কি আজও সমান প্রাসঙ্গিক?

-এস্ট্যাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই এটা তো প্রাসঙ্গিক বটেই। সময় পালটেছে – পরিস্থিতি
বদলেছে কিন্তু ব্যাপারটা একই থেকে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিকতা আরও ছড়িয়েছে, আরও
অন্যরকম হয়েছে। তার রূপ পালটেছে। তখন একটা বা দুটো হাউস পুরো বাংলা
বাজারটা দখল করে রেখেছিল। তারা যাকে কবি বা লেখক বলত – তারাই কবি বা
লেখক। আর বাকিরা কেউ না। একটা জিনিস খুব চালাকি করে প্রচার করা হয়েছিল,
যে লিটল ম্যাগাজিন শুধুই হাত পাকাবার আসর। এখন্ সেটা আর ওভাবে নেই।
আনন্দবাজার বা দেশ-এর এই চাপা কন্ট্রোল এখন আর নেই। এখন তো দেশ-এ লিখতে
লেখকরাই আর interested  নয়। পড়া তো দূরের কথা। এখন সিনারিওটা অন্য।
এখন ব্যাপারটা ব্র্যান্ডিং-এর উপর নির্ভরশীল। আমি কী জামা পরব, কোন ব্রাশ দিয়ে
দাঁত মাজব, অন্যে ঠিক করে দেয়। আমি তো শিখেছিলাম ছোটোবেলায় দর্জির কাছে
গিয়ে জামা বানানো, এখন ওসব আর প্রায় নেই। এটা আরও ভালো বুঝেছিলাম ইয়োরোপে
গিয়ে। প্রায় সব শপিং মলেই একই ব্র্যান্ড, বিশ্ব মার্কেটটা open হয়ে যাওয়ায় একই জিনিস
সব জায়গায় পাওয়া যায়। আমি কলকাতায় বসে নরওয়ের জামা পরতে পারি। তাহলে
ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে আমি সারাক্ষণ monitored হচ্ছি। আমার চুল কাটা ঠিক করবে তারা,
প্রতিষ্ঠানের এই খেলা খুব সূক্ষ্মভাবে মানুষের স্বাধীন চিন্তা কেড়ে নিচ্ছে। বাজার ঠিক
করছে – সমাজে তুমি কীভাবে থাকবে তার normsগুলো। তার বাইরে গেলে হয় তুমি
বাউন্ডুলে নয় সমাজবিরোধী। ফাল্গুনীর (ফাল্গুনী রায়) কথা মনে পড়ে গেল, একটা
ছেলে বিবাহযোগ্য কিনা depend করে তার purchasing power-এর উপর। পয়সা আছে? না
থাকলে বিয়ে হবে না। কে মেয়ে দেবে তাকে? সমাজ কি খুব পালটেছে? ফাল্গুনী সত্তরে
বলেছিল – পয়সা না দেখালে মেয়ের বাবা বা বেশ্যার দালাল কেউই মেয়ে দেয় না।
কিছুই তো বদলায়নি। তাই লড়াইটা থাকবেই।

এখন তো দেখি পাড়ায় পাড়ায় লিটল ম্যাগাজিন। তবে কটা যে আসলেই লিটল ম্যাগাজিন – বোঝা খুব চাপ। এতে কি সামগ্রিক ভাবে লিটল ম্যাগাজিনের জায়গাটা নষ্ট হচ্ছে না?

-আমার সেটা মনে হয় না। কারণ কাজটা হোক, চেষ্টাটা চলুক। সবাই হয়তো পারবে না,
কিন্তু একজন দু’জন তো বেরিয়ে আসবে। জীবনানন্দ বা ফাল্গুনী রায় কি দশটা বিশটা
হয়েছে!!! হয়নি। কিন্তু চেষ্টাটা দরকার।

কিন্তু কোথাও গিয়ে তাহলে একটা সমস্যা তো উঠে আসছে, যারা লিখছে তাদের তো selective  হতে হবে, নাকি randomly  যেই লেখা চাইল দিয়ে দিলাম?

-হ্যাঁ সেটা তো হতেই হবে। স্যুভেনির মার্কা কাগজে লেখা দিয়ে কী লাভ।বা পঞ্চাশ ফর্মার
একটা কাগজ – সেখানেও লেখা দিয়ে লাভ নেই। কেউ পড়বে না। যারা লিখছে – তারা
শুধু নিজের লেখাটা ছিঁড়ে নিয়ে ফাইল-আপ করে রাখে। বাকিদের লেখার দিকে তাকায়
না।

তোমরা যখন আমাদের মতো ছিলে মানে আমাদের বয়সে, যখন যুবক তোমরা...
(কথা থামিয়ে দিয়ে) আমি এখনও যুবক (হা-হা হাসি)। না না বল কী বলবি।

তখন কোনো লিটল ম্যাগাজিনে কেউ একটা ভালো লিখলেই কথাটা হাওয়ায় ছড়িয়ে যেত। অথচ তখন ইন্টারনেট ফেসবুক ছিল না। তবু এটা ঘটত। আজ এত কিছু থেকেও সেটা তেমন ঘটছে না। এর কারণ কী মনে কর?

-তা নয়, আসলে আমার মনে হয়, এখন একে অপরের প্রতি respectটা কেমন যেন কমে
গেছে, মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। respect  মানে শুধু বয়স্ক লোককেই respect  নয়, একটা young
  ছেলেকেও respect  করা যায়। তার লেখাকে respect  করা যায়। নিজের লেখা ছাড়া অন্যের
লেখা পড়ব না – এই মনোভাবটাই এখানে সমস্যার অন্যতম কারণ। এটা নিয়ে কথা
হওয়া জরুরি। ভালোবাসাবাসি কম হয়ে যাচ্ছে? এত ruthlessness  কেন?

সেটাই, মানে বাংলা সাহিত্য কি এখন শুধুই নিজের বা নিজ গোষ্ঠীর পিঠ চুলকানোর জায়গা হয়ে দাঁড়াল?

-পিঠ চুলকানো চিরকালই ছিল, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন জগতে এতটা ruthlessness  ছিল না
বোধহয়। মানে কেউ কাউকে মানি না। আমরা যেমন, ধরা যাক সুনীল গাঙ্গুলিকে
গালাগাল দিলে, তার লেখাটা পড়ে তবেই গালাগাল দিতাম। না পড়ে দিতাম না। ভালো
লাগছে না, আর পড়লাম না। কিন্তু তার সাথে দেখা হলে হাসব না বা অপমান করব –
এর কোনো যুক্তি নেই আমার কাছে। মেনে নিতে না পারলে সরাসরি কথা বলেছি,
ডিসকোর্সে গেছি, কাজের জাস্টিফিকেশন খুঁজেছি। যেমন আবার নাম করেই বলছি, উদয়ন
ঘোষকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘নিজেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী বলছেন অথচ বড়ো
কাগজে লেখার চেষ্টা করছেন, কেন? তাহলে কি আপনি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নন’? তখন
উদয়ন ঘোষ নিজমুখে বললেন – ‘না, আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নই’। তখন বললাম –
‘এটা তো আপনার আগে বলা উচিত ছিল’। কিন্তু তা বলে আমরা তো লোকটাকে
অসম্মান করিনি। তার পরেও আড্ডা মেরেছি। এখন তো আদান-প্রদানের জায়গাটাই
নেই।

উদয়ন ঘোষের কথা ওঠায় মনে পড়ল – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কেও লিটল ম্যাগাজিনের প্রিন্স বলা হতো। কিন্তু তিনিও আজকালে লিখতেন। এই নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, প্রথমত লিটল ম্যাগাজিন তাকে উপন্যাস ছাপার জায়গা দেয় না। দ্বিতীয়ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যারা লড়ে তারাও কোথাও একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়। সুবিমল মিশ্রও শেষ জীবনে প্রতিষ্ঠানের হাত ধরলেন – এগুলো নিয়ে তোমার কী বক্তব্য?

-দেখ, সন্দীপনদার সাথে আমরা খুব ক্লোজ ছিলাম, দিনের পর দিন আড্ডা হতো।
সন্দীপনদা ওনার মিনি বুককে মনে করতেন লিটল ম্যাগাজিন। এছাড়াও সন্দীপনদা প্রচুর
লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছেন। তবু আমি সন্দীপনদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘এটা কেন
করেন’? সন্দীপনদা বলেছিলেন – ‘ভাই দশ হাজার টাকা পাই, সংসার তো চালাতে হবে’।
ভাব, অতবড়ো একজন গদ্যকার, আনন্দবাজার দিল কিছু সম্মান? আজকালে লিখতেন –
যেটা সেভাবে কোনো সাহিত্যের কাগজই নয়। শুধু পুজো সংখ্যা বেরোত।
আর সুবিমলদার প্রথম যে জায়গায় আমি বিরোধিতা করেছিলাম, সুবিমলদার একটা
ইংরেজি বই বেরোয়, যেটা আমার বন্ধু শ্রীধর অনুবাদ করে। বইয়ের ব্যাক কভারে লেখা
ছিল – one and only anti-establishment writer in Bengali literature’.  শ্রীধরকে বললাম – ‘এটা কী
হলো’? শ্রীধর বলল – ‘আমি কিছু করিনি, সবটাই সুবিমলদা নিজে করেছে’। আর এটা
ঘটনা সুবিমলদার বইয়ের সর্বত্র একটা শব্দও সুবিমলদার অনুমতি ছাড়া ছাপা হতো না।
আর ঠিক সেই সময়ে এক বছরের এদিক ওদিক – একটা কাগজে আমার বন্ধু পার্থর
প্রশ্নে মলয়দা বলেন – ‘আমরাই তো প্রথম বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিয়ে
আসি’। তখন আমি বলেছিলাম (হেসে) তাহলে এক কাজ করুন, রাজা নির্বাচন করুন।
বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার রাজা কে (হাসি)? কোনো movement  একা হয় না
 অনেকে মিলে হয়। তাই হঠাৎ এদের মধ্যে এই একমেবাদ্বিতীয়ম হওয়ার এই চেষ্টা আমাকে
অবাক করেছিল। তাও তো মলয়দা এখনও লিটল ম্যাগাজিনে লিখছে আর সুবিমলদা তো
সরাসরি এক মাল্টি ন্যাশনাল পাবলিশার থেকে ইংরেজিতে বই করল। আমি সুবিমলদাকে
বলেছিলাম – ‘এটা কী করলেন? আপনি জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি তো? এটা নিয়ে
কিন্তু প্রশ্ন উঠবে এবং প্রজন্ম প্রশ্ন করবে’? আমি যখন বাংলাদেশ গেলাম, বাংলাদেশ
ফিল্ম মুভমেন্টের জনক মুহম্মদ খসরু আমাকে বলেন – ‘এটা কি সত্যি যে সুবিমলদা
এরকম জায়গা থেকে বই করলেন’? আমার কষ্ট হচ্ছিল, খারাপ লাগছিল, কিন্তু সত্যিটা
স্বীকার করতেই হলো। আমার মনে হয় এই ঘটনায় so called  ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ শব্দটার
কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা। তারপর থেকে আর ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ বলি না আমি।
বলি, আমরা স্বাধীন লেখক, মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছি, কারো কাছে মাথা নোয়াইনি
কখনও। কারও বাড়িতে বই দিয়ে এসে বলিনি – ‘দাদা, দুটো লাইন লিখে দেবেন’।
এভাবেই কাজ করে যাব।

আচ্ছা, কবিদের দশক ভেদ মানে...

-(থামিয়ে দিয়ে) এটা খুব হাস্যকর ব্যাপার। মানে ডাক্তার, উকিলের তো দশক ভেদ হয়
না। মানে ষাটের দশকের ডাক্তার, সত্তর দশকের উকিল। এটা হাস্যকর। এটা কিছু লোক
আলোচনার সুবিধার্থে করেছে। কিন্তু এই নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে
আমি মনে করি না। হয় লেখক, নয় লেখক নয়, ব্যাস।

তোমার প্রথম দিকের কবিতায় যে দীর্ঘ কবিতার প্রবণতা ছিল, এখন একেবারেই দেখি না। কেন?

-এটা কী বলব! অনেক সময় হাগতে গেলে টর্পেডোর মতো ন্যাড় পড়ে (হাসি) আর
অনেক সময় ছোটো ছোটো ন্যাড় পড়ে। তো এখন ছোটো ছোটো ন্যাড় পড়ছে। তো কী
করা যাবে। টর্পেডো বেরোলে টর্পেডো হবে (হাসি)।

বুদ্ধি, আবেগ, অভিজ্ঞতা – কবিতায় কোনটাকে কতটা জায়গা দাও?

-তিনটেই। বুদ্ধি – মানুষ তো, বুদ্ধি করেই বেঁচে থাকি। আর মানুষ তো, আবেগ থাকবেই, না হলে রোবট হতাম। আরেকটা কী বললি...অভিজ্ঞতা...
বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা তো হবেই। অভিজ্ঞতা এই বেঁচে থাকাটা লিখতে সাহায্য করে।
কয়েকটা শব্দ বা লাইনে অনেক কিছু বলা হয়ে যায়, বেশি বকতে হয় না।

গ্রাফিত্তির প্রথম দিকের কাগজ পড়ে জানতে পারি, তখন লিটল ম্যাগাজিন জায়গা পেত না বইমেলায়। আজ এত লিটল ম্যাগাজিন মেলা চারদিকে, বইমেলায় লোকে টেবিল খুঁজে এসে বই নিয়ে যায়। কীরকম লাগে? এত ম্যাগাজিন পাঠককে বিভ্রান্ত করবে না কি?

-এটা তো পজিটিভ। এত ম্যাগাজিন হয়েছে বলেই লিটল ম্যাগাজিন মেলাগুলো হচ্ছে। আর
পাঠক খুব সেয়ানা। সে জানে, কোনটা পড়বে, কোনটা ফেলবে।

এত বছর লেখার পর পাবলিশার পেলে। পরপর দুটো বই পাখিগুলো কোথায় একটা ঘুমোচ্ছে (খোয়াবনামা), আমাদের কোনো ঘোড়া নেই (বিউটিফুল বুলশিট) অন্য পাবলিশার করল। এত বছর লাগল, যেটা কমার্শিয়াল কাগজে লিখলে হত না। আফশোস হয় না?

-আফশোস কেন? কমার্শিয়াল কাগজের খ্যাঁকশিয়াল হইনি বলে? না আমার আফশোস নেই।
আমি সম্মানিত এরা আমার বই করেছেন। বাংলাদেশে ‘প্রতিশিল্প’ আমার বই করেছে।
অ্যামেরিকা থেকে আমার চারটে বই হয়েছে, আর একটার কাজ চলছে। কলকাতার অন্য
কেউ না করলে করবে না। আমার পয়সা থাকলে গ্রাফিত্তি থেকে হবে, না হলে হবে না।
কারণ আমি তো জেনেই নেমেছি এই রাস্তায়। তাহলে মনস্তাপ করব কেন? আমি তো
তাদের গোয়ালে ঢুকিনি – কেন ছাপবে তারা (হাসি) – সকলের সাথে গলা মিলিয়ে
হোক্কা হোয়া কেন করতে হবে আমায়?

একটা বই থেকে আরেকটা বইয়ের মাঝখানে কী কী ভাবনা চিন্তা রাখ? নতুন বই মানেই তো নতুন কিছু প্রেজেন্টেশন, কী কী পরিবর্তন চাও?

-আসলে আমি চিরকাল যেটা ভেবে এসেছি, লেখালিখির দু’তিন বছর পর পর একটা বই
করলে লেখাটা পালটায়। কারণ লেখাগুলো ছেপে বই হয়ে গেলেই, সেই ধরনের লেখার
প্রতি আর টান থাকে না। মনে হয় – ঠিক আছে এটা তো হয়ে গেছে, এবার অন্য কিছু
করি। এবং এটা ভেবে চিন্তে নয়। ভিতর থেকেই হয়। একটা flow  তো, ups and downs  থাকে।
একটা খুব ভালো বইয়ের পর ভীষণ খারাপ একটা বইও হতে পারে। তাই বই করে
ফেলো। তোকে আর অন্তত অনেককে এটা বলেছি আমি। এটাই তোমার শ্রেষ্ঠ বই হবে –
নোবেল পাবে এসব না ভেবে কাজটা কর।

২০১৩-এ ‘একা শহর’, ২০১৪-এ ‘পাখিগুলো কোথায় একটা ঘুমোচ্ছে’ আর ‘আমাদের কোনো ঘোড়া নেই’, একসাথে দুটো বই, দু’বছরে তিনটে বই – সচরাচর এরকম কাউকে করতে দেখি না। এরকম করার কারণ কী?

সময় নিয়ে কী হবে? ছ’মাস পরে বাঁচব কিনা তার ঠিক নেই...আমি ফিউচার নিয়ে ভাবি
না। আমার কাছে আজকের দিনটা হলো বেঁচে থাকা আর কালকের দিনটা বোধহয় বেঁচে
থাকা। আমি এভাবেই ভাবি। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুম যেতে পারব কিনা জানি না,
মরে পড়ে থাকতে পারি। এত অপেক্ষার সময় আমার নেই। লিখেছি, লেখাটা হয়েছে – বই
করে ফেলো। লেখা হয়নি তাহলে করব না। অপেক্ষা আমার ধাতে নেই।
আমার way of writing  এটাই।

বাংলা কবিতায় ইদানিং খুব দেখছি পোস্টমডার্ন কবিতা বা পুনরাধুনিক কবিতা বলার হুজুগ। একি শুধুই কবিতাকে ট্যাগমার্ক দেওয়ার চেষ্টা? কী মনে হয়?

এটা হলো একটা প্যাকেটে বাসি চানাচুর, আবার আর একটা প্যাকেটে মনোহর চানাচুর
বা হলদিরামের চানাচুর। চানাচুরই তো আলটিমেটলি। কোথাও একটু টক ছিল বেশি
করে – এই যা তফাৎ। কবিতাটা কবিতাই। ওসব তকমা মেরে কোনো লাভ নেই।
থিয়োরিগুলো জানলে সমাজকে বুঝতে হয়তো সুবিধে হয় কিন্তু তাতে করে লেখালিখিতে
কোনো লাভ হয় বলে আমার মনে হয় না। বরং পাঠক ভয় পাচ্ছে, সরে যাচ্ছে।
কমিউনিকেট করতে পারছে না বলেই। কবি ভাবলেন কতগুলো শব্দ শুধু আমি জানি,
আমি লিখব সেগুলো – আহা কী একটা নতুন শব্দ তৈরি করলাম – আমি মহান। আরে,
নতুন শব্দ যে বানালে, তাতে কী এসে গেল? সেই আবার বলি, কনটেন্ট না থাকলে
শুধু structure  দিয়ে হবেটা কী?

হাংরি আন্দোলন নিয়ে তোমার কী মত? অনেকেই বলে, এই আন্দোলনে কোনো কাজের কাজ হয়নি, slang  হয়েছে খালি। বাংলা সাহিত্য কি কোনোভাবে হাংরির দ্বারা উপকৃত হয়েছিল আসলেই?

অনেকই উপকার হয়েছে। হাংরি বললেই আমরা ভাবি slang  । আর যদি তাও হয়, খারাপ
কী? এটা লিখতে গিয়ে হাত কেঁপে আরও ১০০ বছর কেটে যেত। একটা মেয়েলি ভাষাকে
পুরুষ করার দিকে এগিয়ে দিয়েছে হাংরি। আমাদের ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ আছে, সবাই তাকে
তুলে রাখি। কেউ পড়ি না। রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন – ‘ভড়ভড় করে হাগতে দোষ নেই,
বললেই দোষ’? তাতে কিন্তু রামকৃষ্ণদেব খারাপ হননি (হাসি)। যেই হাংরিরা বা ফাল্গুনীর
মতো কবিরা বলল – ‘বোনের বুকের থেকে সরে যায় অস্বস্তিময় চোখ’...অমনি কথা উঠল
– ওরেঃ শালা! একী হলো রে? এই জন্য আবার বলি, আমার কাছে ন্যাড়ের মতোই
কবিতা। কবিতা নিয়ে পুজোপাঠে বসে গেলাম গঙ্গা জল ছিটিয়ে, এটার মানে কী? কবিতার ব্রাহ্মণ্যবাদ!!! আলাদা করে রাখা। কবিতা এলিটিস্টদের সম্পত্তি নাকি? আমি এমন এক ভাষায় লিখব যে তুমি ছাড়া কেউ বুঝবে না – একটা গোপন ভাষা তৈরি করা যেন। সাংঘাতিক ব্যাপার। সেই মায়ান পুরোহিতদের মতো। কন্ট্রোলের ভাষা।




কিন্তু কমলকুমার বাবুও তো সেটাই করেছিলেন তাই না? একটা আলাদা নতুন ভাষা তৈরির চেষ্টা?



আমি কিন্তু কন্ট্রোলের ভাষার কথা বলছি। কমলকুমারের ব্যাপারটা আলাদা। তিনি হলেন লেখকের লেখক। কমলকুমার ভালো ভাবে পড়লে সেটা বোঝা যাবে। অনেকে বলে তার ফ্রেঞ্চ সিন্ট্যাক্স, এই সেই, ওসব কিস্যু না। পুরোনো বাংলা ভাষাকে নতুন করে রিপ্রেজেন্ট করা। কিন্তু তার মধ্যে এসব দুনম্বরি representation  নেই। বোধ আছে। কমলকুমার পড়লে বোঝা যায় –বেদ, বেদান্ত, পুরাণ ভদ্রলোকের গুলে খাওয়া। এবং তিনি একজন ভারতীয় লেখক। সেটা তাঁর লেখায় খুব স্পষ্ট। তাঁর লেখা আমাকে শিক্ষা দেয়। তার মানে এই নয় যে আমি তাঁর মতো লিখব – লিখব না। কিছু কিছু বই থাকে না শিক্ষা দেওয়ার। কমল বাবুর বই হলো সেটাই। এই বই কাউকে শিক্ষিত করতে পারে।

কিন্তু এখন তো মনে হয় কমলকুমার বেঞ্চমার্ক হয়ে যাচ্ছেন। হয়তো পড়িনি, তাও বলছি পড়েছি। না হলে লোকে কী বলবে?

ধুর সে তো  name dropping , বাচ্চাবেলায় হয়। এককালে আমিও বলতাম, আহা জেমস জয়েস, অসাধারণ লেখক। জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’-এর শব্দ তৈরির ফাঁদ আমায় টানে না। পরে জেমস জয়েসের ছবি দেখেছি। দেখে মনে হয়েছে – ইস, এ ভদ্রলোকের নির্ঘাত পটি হয় না (হা হা করে হাসি)। ‘ডাব্লিনারস’ ছাড়া জয়েসের কিছুই এখন পড়তে পারি না। এখন থেকে বহুদিন আগে একটা গল্প অনুবাদ করেছিলাম অবশ্য। সেটা হারিয়ে ফেলেছি যথারীতি, সাম্প্রতিক উত্তরণ-এ ছাপা হয়েছিল। তা তিনি ছিলেন মহান লেখক, এখনও আছেন নিশ্চয়ই। কাফকার লেখা – সেতো খালি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দুঃস্বপ্নের গল্প। টানে না আমায় আর। কাফকাও তো মহান লেখক। পিটার অরলভস্কি ভালো বলেছিল –
‘আমার দেখা হয়েছিল কাফকার সাথে।
আমাকে দেখেই সে বাড়ি টপকে পগারপার’।

বব ডিলানও তো ট্রিপ নিয়ে তারপর লেখেন ‘ট্যারান্টুলা’ – দুঃস্বপ্ন, প্রতীকী এইসব...

ট্রিপ দু’রকমের হয় – গুড ট্রিপ আর ব্যাড ট্রিপ। ওর ব্যাড ট্রিপ হয়েছিল। সে তো স্টিভ রিচমন্ডও ‘ডেমনস’ লেখে ট্রিপ নিয়ে। একই ব্যাপার।

একটা সময় গ্রাফিত্তি, উত্তরপর্ব এই বিষ অর্জন একসাথে করেছ। আবার কবিতা ক্যাম্পাসেও ছিলে, এতগুলো কাগজ একসাথে কেন?

একসাথে নয়। আলাদা আলাদা। শুরু করেছিলাম ‘সমবেত আর্তনাদ’ দিয়ে। আমার আবার একটা ব্যাপার আছে। ক’দিন পর পর কাগজের নাম পালটাতে ভালো লাগে। তারপর হলো উত্তরপর্ব এই বিষ অর্জন – বিসর্জন ভেঙে করলাম বিষ অর্জন। তারপর ভাবলাম ধুর এসব করে লাভ নেই। একটা গ্রাফিত্তি করি। ব্যাস।

‘হোক কলরব’ সেই রাস্তায় নামা। সেদিন বৃষ্টিতে তুমি, আমি দু’জনেই হেঁটেছিলাম মিছিলে। ‘হোক কলরব’ একটা অদ্ভুত রংহীন প্রতিবাদ লেগেছিল। অথচ বাংলা সাহিত্যের বহু প্রতিবাদী নাম সেদিন উধাও ছিল। কী রকম অনুভূতি ছিল সেটা?

আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিল সেদিন মিছিলে হাঁটতে পেরে। পৃথিবীর যে কোনো বিপ্লব তরুণ ছাত্ররাই করে। এটা একটা শুরু মনে হচ্ছিল। নতুন কিছুর, নতুন হাওয়ার। আমরা পাশে ছিলাম যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের।

গ্রাফিত্তি নিয়ে কী ভাবছ – আগামী পরিকল্পনা?

কাগজটা আবার শুরু করেছি। অনেক কিছু বলার আছে। আপাতত পরপর তিনটে সংখ্যা আসছে। ডিসেম্বর ২০১৪, জানুয়ারি ২০১৫, ফেব্রুয়ারি ২০১৫। দেখা যাক।

কবিতায় ছন্দ ব্যবহার আজ কি আর আদৌ জরুরি, মানে সেই মাত্রাবৃত্ত, কলাবৃত্ত, সনেট লিখব – এরকম ভাবার আজ কি আর দরকার আছে?

এককালে লিখেছি আমিও ছন্দে। কিন্তু আলটিমেটলি আমার মনে হয়েছে, টের পেয়েছি যে প্রকৃতির একটা নিজস্ব ছন্দ আছে। এই যে কথা বলছি, কটা শব্দ এক নিঃশ্বাসে বলতে পারব, সেটা কিন্তু মাপা। আমি কখন নিঃশ্বাস নেব, কখন ছাড়ব সেটাও মাপা। এটাই ছন্দ আমার কাছে, নিঃশ্বাস নেওয়া আর ছাড়াটাই ছন্দ। লেখার সময়ও এই প্রক্রিয়াটা চলে– সেটা আমার ভিতরেই আছে, আলাদা করে আঙুল গোনায় আমি বিশ্বাসী নই আর। so called sonnet লিখব বলে বসলাম, পারলাম না। যদি ভেতর থেকে আসে হলো – এল না তো হলো না।

সম্প্রতি একটি কাগজে কবীর সুমন বলেছেন – বাংলা গানে মহীনের ঘোড়াগুলির কোনো অবদান নেই, আটটা-দশটা গান দিয়ে হয় না ইত্যাদি...

কে কবীর সুমন!!!

নতুন বই কি পাব?

বইমেলা ২০১৫-এ বত্রিশ পাতার নতুন চ্যাপ বুক ‘বত্রিশ পাতা’ (হাসি)


কথা বলেছেন অভিষেক চক্রবর্তী
১৮০ ডিগ্রি পত্রিকা-তে প্রকাশিত

     

              



No comments:

Post a Comment