বয়স বাড়লে বোধহয় মানুষকে
ছোটোবেলা পেয়ে বসে। না হলে এতদিন পর আবার সেই বহুদিনের পুরোনো বিকেলগুলো মনে পড়ছে
কেন? বাবা-মা’র সাথে কাটানো সব বিকেল। শনি-রবিবার স্কুল থাকত না বলে সেসব দিন এই
চা-এর আড্ডায় এসে জুটতাম গুটিগুটি। চা-এর প্রতি বাবার প্রেম ছিল অসীম। আর ছিল চা
খেতে খেতে নানান গল্প বলার প্রবণতা। আর এই গল্প শোনার লোভেই আমার এই চুপি চুপি
প্রবেশ। চুপি চুপি এইজন্য যে এমন হতেই পারত যে বাবার মনে হল হঠাৎ আমি ঠিকঠাক
পড়াশুনো করছিনা, তখন পত্রপাঠ আমাকে ফের পড়ার ঘরে পাঠিয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না। তবে
তা কদাচিৎ ঘটত। কে আর না চায় তাকে ঘিরে শ্রোতারা থাকুক যখন সে গল্প বলছে। বাবা
কিছু গল্প বারবার বলতেন। বিশেষত সেই পাঠানের গল্, মিলিটারিতে লড়াই করার
সময় যার বাঁ হাতের দুটো আঙুল উড়ে গেছিল। অথচ হাসপাতাল, বিলেতি ডাক্তারের অভাবে
বিবির পট্টি, দাদীমার জড়িবুটি আর মোল্লাজীর ঝাড় ফুঁকে সেরে গিয়েছিল। এখন দেখলে মনে
হবে সে যে্ন জন্মেছে বাঁ হাতের দুটো আঙুল ছাড়াই। পরে বুঝেছি এ গল্পগুলোর উৎস আসলে ‘দেশে
বিদেশে’। ‘দেশে বিদেশে’ আর চা-এর প্রতি যে একটা প্রবল প্রেম ছিল বাবার তা আরো
স্পষ্ট হবে এ কথা বললে যে বাবার একটা সামোভার ছিল। জীবনের প্রথম ব্যাবসার সময়ই সেটা
জোগাড় করে থাকবেন বাবা। বেন্টিং স্ট্রিটে এক বন্ধুর সাথে মিলে কাপ প্লেটের সে
ব্যাবসা যদিও তখন উঠে গেছে বহু দিন। কিন্তু ওই সামোভার আর কিছু কাপ প্লেট রয়ে
গেছিল স্মৃতি হিসেবে। রাশান গল্পে এই সামোভারের কথা আপনারা পড়ে থাকবেন। তা এই
সামোভার বস্তুটি কী? এটি একটি ধাতুর পাত্র। টিবিলে রেখে তাতে চা-এর জল গরম করা হয়।
অর্থাৎ কাপের পর কাপ চা যারা খেতে ভালোবাসেন এটা তাদের জন্য। বাবা রাশান গল্পে হয়ত
পড়ে থাকবেন এর কথা কিন্তু তার কাবুলি প্রীতি দেখে মনে হত তিনি এটা জেনে থাকবেন
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ বই থেকে। এবং তারপরই হয়ত তাশখন্দ থেকে কাবুল হয়ে
কলকাতায় আসা এই সম্পদটি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। পরে জেনেছি তার এই কাবুলি প্রীতির
আসল উৎস একটা ইংরেজ বিদ্বেষ থেকে যা তাকে কোট প্যান্ট ঘেন্না করতেও শিখিয়েছিল।
এবার একবার ফিরে পড়া যাক
‘দেশে বেদেশে’-র সেই সামোভার আর রাশানদের চা খাওয়ার গল্প। সৈয়দ মুজতবা আলী তখন
কাবুলে পড়াচ্ছেন। শান্তিনিকেতনের আরেক শিক্ষক বেনওয়াও তখন ওখানে। তার সাথে একদিন
রাশান এমব্যাসিতে গেলেন। ‘আমি বাঙালী, বেনওয়া সাহেব শান্তিনিকেতনে থেকে থেকে আধা
বাঙালী হয়ে গিয়েছেন। আর রাশানরা যে চা খাওয়াতে বাঙালীকেও হার মানায় সে তো জানা
কথা। তবে খাওয়ার কায়দাটা আলাদা। টেবিলের মাঝখানে সামোভার, তার জল টগবগ করে ফুটছে।
এদিকে টি-পটে সকাল বেলা মুঠো পাঁচেক চা আর গরম জল দিয়ে একটা ঘন মিশকালো লিকার তৈরী
করা হয়েছে – সেটা অবশ্য ততক্ষণে জুড়িয়ে হিম হয়ে গিয়েছে। টি-পট হাতে করে প্রত্যেকের
পেয়ালা নিয়ে মাদাম শুধান, ‘কতটা দেব বলুন’। পোয়াটাক নিলেই যথেষ্ট, সামোভারের চাবি
খুলে টগবগে গরম জল তাতে মিশিয়ে নিলে দুয়ে মিলে তখন বাঙালী চায়ের রঙ ধরে। কায়দাটা
মন্দ নয়। একই লিকার দিয়ে কখনো কড়া, কখনো ফিকে যা খুশী খাওয়া যায়। দুধের রেওয়াজ
নেই, দুধ গরম করার হাঙ্গামাও নেই। সকালবেলাকার তৈরী লিকারে সমস্ত দিন চলে।‘ মাদামের
এই সামোভারটি ছিল রুপোর তৈরী। দুদিকের হ্যান্ডেল, উপরের মুকুট, জল খোলার চাবি,
দাঁড়াবার পা সব কিছুতেই পাকা হাতের সুন্দর, সুদক্ষ, সূক্ষ্ম কাজ করা। পরে জানা গেল
এটি তুলা শহরে তৈরী। যা শুনে মুজতবা আলীর মনে পড়ে যাবে সেই রাশান প্রবাদটির কথা। ‘তুলাতে সামোভার নিয়ে
যাওয়ার মত’। আমরা বাঙলাতে বলি, ‘তেলা মাথায় তেল ঢালা’। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো সব
প্রবাদের কথা বলবেন। ‘কেরিইং কোল টু নিউ ক্যাসল’, ‘বরেলি মে বাঁশ লে জানা’
ইত্যাদি। সে সব নিয়ে আলোচনাও হল। শুধু একটি ফরাসী প্রবাদের কথা মনে পড়লেও তিনি
অবস্থা বুঝে আর বলেননি, ‘প্যারিসে আপন স্ত্রী নিয়ে যাওয়া’। এই হলেন সৈয়দ মুজতবা
আলী। বাংলা ভাষা সাহিত্যে এরকম হিউমার যার সঙ্গে কিছুটা হৃদয় কিছুটা পাণ্ডিত্য
জডিয়ে তা খুব বেশি লেখকের লেখায় পাওয়া যায়না। শিক্ষা, আভিজাত্য ও হিউমারে মোড়া তার
লেখালিখি। কখনই তাকে পাণ্ডিত্য জাহির করতে দেখা যায়না। শুধু তার ঝলক টের পাওয়া
যায়। সে এক অন্য পাঠ অভিজ্ঞতা। এ বই যেমন পড়া যায় ট্রাভেলগ হিশেবে তেমনই
আফগানিস্থানের ইতিহাসের একটা প্রাথমিক খসড়া হিশেবেও। আর এ বইয়ের অর্ধেক গল্পই
ছোটবেলা থেকে বাবার মুখে শুনে শুনে মাথায় গেঁথে আছে বলে তা ফিরে পড়তে গেলে
ছেলেবেলার সেই বিকেল গুলোও ফিরে ফিরে আসে। আর তার প্রিয়তা বেড়ে যায় বহুগুন।
No comments:
Post a Comment