Wednesday, January 9, 2019

আরো খানিকটা স্টকহোম






আজ হেনরির বাড়িতে নিমন্ত্রণ। সন্ধ্যেবেলা বোয়েল আসবে আমায় নিতে। বেরিয়ে পড়লাম আরেকবার। হোটেল থেকে কিছুটা এগিয়ে গাছ ঘেরা একটা বাগান আছে। আগে রাজরাজড়ার ছিল। এখন ওটা সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।




 সকাল থেকেই অন্ধকার হয়ে আছে চারদিক। কাল যদি এথেন্স যেতে হয় কিছুটা ইউরো হাতে থাকা উচিৎ। সুইডিশ ক্রোনা আবার এথেন্সে চলবে না। বাগানের একটা পাশে বাচ্চাদের আইসস্কেটিং রিং আছে। বাচ্চাদের হুটোপুটি চিৎকারে থেমে দাঁড়িয়ে দেখলাম। আশেপাশে কয়েকটা খাবারের স্টল আর কফি ঘর নজরে পড়ল কিন্তু সব বন্ধ। এক কাপ কফি খোয়ার জন্য প্রাণটা ছুকপুক করছিল কিন্তু উপায় নেই। বড় দোকানগুলোতে ঢুকতে ভরসা হয় না। কত দাম নেবে কে জানে! আরো খানিকটা এগিয়ে বাঁদিকে দেখি একটি ছেলে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুকফুক করে সিগ্রেট ফুঁকছে। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে তার পিছনে একটা বিরাট শপিং মলের ভিতরে চলে যেতে বলল। পরে বুঝলাম সে আসলে এই মলেই কাজ করে। খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরে একটা কফি ঘরে কফি খাওয়া গেল। প্রাণ শান্ত হলো। এবার ফিরে হোটেলে বোয়েলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।



হেনরির স্টাডিটা লম্বাটে। প্রায় পুরো ঘরটা জুড়েই দেওয়ালে লাগানো একটা এল শেপের টেবিল। যার একদিকে ওর কম্পিউটার আর প্রিন্টার আর অন্যান্য টেবিলে লেখালিখির খাতা কলম বই ছড়ানো। হেনরি জানে ওর ভেতর আরেকটা হেনরি আছেযার ও নাম রেখেছে মিস্টার ব্লু। সেই হেনরি পেইন্টার। প্রচুর ওয়াটার কালারের কাজ, প্রিন্ট-এর কাজ সে করে। সারা ঘরময় ছড়িয়ে আছে শেষ হওয়া আর না হওয়া কাজগুলো। প্রধানত আমেরিকার নানান লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে ছড়িয়ে আছে এইসন পেইন্টিং, স্কেচ। এর ভেতর দুটো অসাধারণ কাগজ তো আমার সংগ্রহেই আছে The Vertin Press-এর The Cliffs Soundings এবং Aggressive Behaviour Anthology 2 . এই লেখাটা যখন লিখছি তখনই হুইড্রা থেকে পাঠানো হেনরির নতুন কবিতার বইটা হাতে এলো। Lummox Press প্রকাশিত The Accidental Navigator, যেখানে আফটার ওয়ার্ডে Gerald Locklin তাকে আমেরিকার কবি Edward Field, Charles Bukowski, Ron Koertge, Billy Collins-এর পাশে স্থান দিয়েছেন। যদিও হেনরি থাকে সুইডেনে আর মাঝে মাঝে নিজের বাড়ি হুইড্রায়। আর তার হুইড্রার বাগানের অলিভ নিয়ে তার গর্বের শেষ নেইপরের বার হেনরি, এক বোতল অলিভ আমার কোলকাতার বন্ধুদের জন্য দিয়ো।
আমি এথেন্স যাব অথচ এখনো টিকিট কাটা হয়নি শুনে হেনরি কম্পিউটার নিয়ে বসে গেল অনলাইনে টিকীট কাটতে। কিছুক্ষণ পর কাগজে প্রিন্ট আউট বেরোলো আমার ই-টিকিটের। ক্রোনা আর ইউরো মিলিয়ে আমি তার দাম মেটালাম। খেয়ালই ছিল না সুইডেনে ইউরো চলে না। পরের দিন ভোর পাঁচটায় আমার হোটেল থেকে যে ট্যাক্সি আমায় তুলবে তার ব্যবস্থা হয়ে গেল হেনরির বাড়িতে বসেই।
হেনরি মিনি বুক বের করে তার বাড়িতে বসেই। প্রকাশনার নাম কামিনী প্রেস।
-আচ্ছা কামিনী মানে কী? আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল হেনরি।
-কামিনী মানে নারী যাকে আমরা চাই।
-তাহলে তো ঠিকই আছে।
যে লিভিং রুমটায় বসে আমাওরা ওয়াইন খাচ্ছিলাম তার এক পাশে কামিনী প্রেসের ওয়ার্কশপ। কাটিং টেবিলে জড়ো করা আছে কবিতার নতুন মিনি বুকগুলো। যা হেনরি নিজেই কাটাকাটি করে তৈরি করে।

-তুমি আমার হুইড্রার বাড়ির চাবিটা নিয়ে যাও। এথেন্স থেকে বোটে কয়েক ঘন্টার পথ এই হুইড্রা দ্বীপ।
-না হেনরি আমি একা গিয়ে ওখানে কী করব? পরে যাব কখনো যখন তুমি থাকবে। আর তুমুল কবিতাপাঠ আর আড্ডা হবে তখন।
-ইয়ানিসের কিছু খবর পেলে?
-না ইয়ানিসের কোনো খোঁজ নেই। সবে বিয়ে করেছে এখন। জাস্ট ডুব মেরেছে। এখন ওর হদিস পাওয়া মুস্কিল। আর তা ছাড়া আমার আরো কিছু বন্ধুবান্ধব আছে এথেন্সে খুব অসুবিধে হবে না। কোলকাতায় বসেই প্লাকায় একটা ইউথ হস্টেল বুক করেছিলাম তাই বুকে একটা ভরসা তো ছিলই। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই থাকলে বাকিটা লড়ে নেওয়া যাবে।
পিৎজা খেয়ে রাতের খাওয়ার সেরে বেরিয়ে পড়লাম আমি আর বোয়েল। রাস্তায় এক বোতল ফ্রুট জুস আর একটা স্যান্ডউইচ কিনে নিলাম। অত সকালে কী খাবার জুটবে কে জানে। মনে পড়ছিল হেনরি কতগুলো বই আমাকে সই করে দিতে দিতে বলছিল – I am not working. পরে টের পেলাম তার টিসার্টে ওই কথাগুলোই লেখা ছিল।
বাকি পথটা ট্যাক্সিতে বসে কথা বলতে বলতে কখন পথটাই ফুরিয়ে গেল। বিদায় বলতে কোথায় যে কষ্ট হয়। তবু বিদায় বোয়েল আবার কখনো কোথাও নিশ্চয়ই দেখা হবে আমাদের ডিয়ার। বিদায়।
হোটেলের ঘরে ফিরে প্রায় গোছানো সুটকেশটাতে ফিনিশিং টাচ দিয়ে নিলাম। হ্যান্ড লাগেজে ক্যামেরা ইত্যাদি জামার মধ্যে সেট করে নিলাম যাতে ধাক্কা লেগে ভেঙে না যায়। এরপর সোজা বিছানায়। পেটে তখনো টলটল করছে হোয়াইট ওয়াইন। হেনরি বোয়েল কেউই মদ ছোঁয় না আমার সঙ্গে সঙ্গ দিতে তারা খেল স্পার্কলিং ওয়াটার। সোডা মেশানো এক ধরণের জল যা আমার একটুও ভালো না লাগলেও ইয়োরোপিয়ানদের খুব প্রিয়।





রাত দুপুরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘরের পোর্টহোল দিয়ে বাইরের অন্ধকার উঁকি মারছে। মোবাইলটায় সময় দেখতে গিয়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না কটা বাজে। একটা চাপা টেনশন কাজ করছিল। নাহ উঠে পড়া যাক। বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ধরাচূড়া পরে জাহাজের ডেকে একটা কাচ ঢাকা ঘরে ব্যাগপত্তর নিয়ে বসলাম। বাইরে ঝর ঝর করে বরফ পড়ছেএকটা মরা হলুদ আলোর ভেতর। এভাবে বরফ পড়তে আগে কখনো দেখিনি। ক্যামেরাটা বার করে কয়েকটা ছবি তুললাম জাহাজটার। কেউ কোথাও নেই। ফ্রুটজুস আর স্যান্ডউইচের গতি করতে করতে ভাবছিলাম কীভাবে কত দ্রুত না ভিজে রিসেপশন অবধি যাওয়া যায়। খাওয়া শেষ করে ‘বলো বীর’ আর ‘জয় মা’ একসাথে বলতে বলতে গন্ধমাদন সুটকেশ আর নিজেকে সামলানোর সার্কাস দেখাতে দেখাতে অবশেষে রিসেপশনে। নিজেকে কেমন একটা তেঞ্জিং তেঞ্জিং মনে হচ্ছে।
আমার মোবাইলটার ভারতীয় সময় আর ইয়োরোপের সময়ের তালগোল পাকানো ঘেঁটে যাওয়া ব্যবস্থায় আমি রিসেপশনে রাত তিনটের সময় এসে উপস্থিত। জমা দিয়ে দিয়েছি আমার চাবি-কার্ড। এরপর একটা লম্বা অপেক্ষা ছাড়া উপায় থাকে না আর। মাঝে মাঝে ইউরো স্লট মেশিনে ঢুকিয়ে কফি খাওয়া ছাড়া। বাইরে ঘন হলুদ রাত্রি জুড়ে ছেঁড়া ছেঁড়া তুলোর মতো হালকা বরফ পড়ছে অফুরন্ত। আর আমি ভাবছি এই বরফে প্লেনটা ছাড়বে তো?
ঠিক পাঁচটায় একটা গাড়ির হেড লাইটের আলো দূর থেকে আসতে দেখে নড়ে চড়ে বসলাম। এই সেই ট্যাক্সি যা আমাকে আরলান্ডা এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।

   



No comments:

Post a Comment